শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘বৃষ্টির শহরে’ ভালো নেই হুমায়ূন

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

‘বৃষ্টির শহরে’  ভালো নেই হুমায়ূন

সিলেটে চাচা আজিজুর রহমানের সঙ্গে কিশোর হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূনের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত শহর সিলেট। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুও এখানে। বাবার চাকরির সুবাদে সিলেটে অবস্থানকালীন সময়ে জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিকের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ শহরে। প্রিয় শহরের টানে বড় হয়েও বারবারই সিলেটে ফিরে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কখনো মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে, কখনো হাওরে জ্যোত্স্না উপভোগের রোমান্টিকতায়, আবার কখনো শাহজালালের মাজার জিয়ারতের আধ্যাত্মিক আরাধনায়। নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখায় হুমায়ূন লিখেছিলেন, ‘সিলেট তার প্রিয় শহর’। প্রিয় শহরকে উল্লেখ করেছেন ‘বৃষ্টির শহর’ হিসেবে। সেই বৃষ্টির শহরে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও তা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কালজয়ী এই লেখকের জীবনকর্ম নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে তার স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সিলেটের সাহিত্যিক ও গবেষকরা।

বাবার চাকরির সুবাদে সপরিবারে সিলেট চলে আসেন হুমায়ূন আহমেদ। বাবা ফয়জুর রহমান ছিলেন সিলেট কোতোয়ালি ও বিশ্বনাথ থানার কর্মকর্তা। শৈশবেই বইয়ের প্রতি ছিল তার মারাত্মক টান। সময় পেলেই তিনি ছুটে যেতেন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও বোন সুফিয়া খাতুন শেফুকে নিয়ে আসতেন প্রাচীন এই সাহিত্য সংসদের পাঠাগারে। বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফেরার সময় বাসায় পড়ার জন্য নিয়ে যেতেন কিছু বই। মুসলিম সাহিত্য সংসদের সঙ্গে হুমায়ূনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই সেখানে। সাহিত্য সংসদের পাঠাগার ঘুরে হুমায়ূন আহমেদের একটি ছবিও দেখা যায়নি সেখানে।

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সহসভাপতি কবি ও প্রাবন্ধিক সেলিম আউয়াল বলেন, ছোট্ট হুমায়ূনকে মুসলিম সাহিত্য সংসদের সদস্য করে দিয়েছিলেন তার বাবা ফয়জুর রহমান। ফয়জুর রহমানও ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। তিনি নিজেও সাহিত্য সংসদে আসতেন। ছোটবেলায় হুমায়ূন তার ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে সাহিত্য সংসদের পাঠাগারে আসতেন বইয়ের টানে। বইয়ের প্রতি তার যে আমৃত্যু টান ছিল তার নেপথ্যে এই পাঠাগারটি ছিল অন্যতম। সিলেট নগরীর মিরাবাজারের একটি বাসায় থাকতেন হুমায়ূনের পরিবার।

বাসার মালিক ফয়জুর রহমান খানের ছেলে মো. এহিয়া খান জানান, হুমায়ূন আহমেদের পরিবার যে বাসায় থাকতেন সে ঘরটি না থাকলেও যে ইন্দিরার (কুয়ো) পানি ব্যবহার করতেন সেটি এখনো আছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হুমায়ূন ভক্তরা তার স্মৃতিবিজড়িত ইন্দিরাটি দেখতে আসেন।

হুমায়ূন আহমেদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় নগরীর মিরাবাজারের কিশোরী মোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়েই প্রথম পাঠ নেন হুমায়ূন অনুজ জাফর ইকবাল ও বোন শেপুও। সেই স্কুলে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি কক্ষ হুমায়ূনের নামে নামকরণ করা হয়েছে বলে জানান স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা রিনি চক্রবর্তী।

রিনি চক্রবর্তী জানান, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অবগত করতে প্রতিবছর তারা হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকেন। এ বছরও তারা মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের নামকরণ কজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় আন্দোলনে নামে মৌলবাদী গোষ্ঠী। সে সময় মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সিলেটে এসে অনশন করেন হুমায়ূন আহমেদ। এক লেখকের রাজপথে আন্দোলনে নেমে আসা সেই দিনটির পর থেকেই সিলেটবাসীর হৃদয়ে তিনি আসন গড়ে নেন। সিলেটবাসীর কাছে একজন লেখকই নন— সহসংগ্রামী, মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন নামও।

সিলেটকে হুমায়ূন আহমেদ হৃদয়ে ধারণ করতেন। তাই সুখে-দুঃখে তিনি ছুটে আসতেন সিলেটে। গুলতেকিনকে বিয়ের পর হানিমুনে তিনি ছুটে এসেছিলেন সিলেটে। রিকশায় চড়ে গুলতেকিনকে শৈশবের শহর সিলেট দেখিয়েছিলেন তিনি— এমন তথ্য জানালেন সিলেটে অবস্থানরত হুমায়ূন আহমেদের চাচাতো ভাই মঞ্জুর আহসান।

সিলেটের সাহিত্যিক ও গবেষকরা মনে করেন সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হুমায়ূনস্মৃতি রক্ষায় প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ।

সর্বশেষ খবর