শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

ওসিমা ক্যাম্প জো থেকে ছাগামি হারা লেকে ছোটাছুটি

পি.আর. প্ল্যাসিড

ওসিমা ক্যাম্প জো থেকে ছাগামি হারা লেকে ছোটাছুটি

ওসিমা ক্যাম্প জো-এর পাহাড়ি সবুজ দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। উপরে নীল আকাশ, নিচে কলকলিয়ে ধেয়ে চলা নদীর পরিষ্কার পানি। চোখকে বারবার টেনে নিয়ে যায় এক অন্য রাজ্যে। পাশে সুন্দরী জাপানিজ মেয়ের সমাগমও মিলিয়ে যায় প্রকৃতির টানে। আর ছাগামি হারা লেকের রূপ বৈচিত্র্য যেন আর্টিফিশিয়ালভাবে তৈরি। সবুজের চারপাশের পানি আর পানি। সব ঋতুতেই ভ্রমণ বিলাসীদের আকৃষ্ট করে এখানকার রূপ বৈচিত্র্য। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় গাছের পাতার রং বদলে হয় লাল, হলুদ, সবুজ।

 

সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা ওসিমা ক্যাম্প জো-তে। আমাদের বাড়ি থেকে কাছের রেল স্টেশনের নাম নিশি উরাওয়া। ট্রেন লাইনের ম্যাপ দেখে জেনে নিলাম এর মধ্যে ট্রেন বদলানো হবে তিনবার। প্রথম গিয়ে পৌঁছলাম নিশি কুকোবুনজি স্টেশন। সেখান থেকে চ্যুয়ো লাইনে হাচিওজি স্টেশন। সঙ্গে আমার ছেলে থাইও প্ল্যাসিড ও তার মা ইউকি খামিজো। প্লাটফরম বদলে গিয়ে উঠলাম ইয়োকোহামা লাইনে। কয়েক স্টেশন পরেই হাসিমতো স্টেশন। হাসিমতো থেকে আবার কেইহিন ছাগামি হারা লাইনের ট্রেনে চড়লাম। এখানে ট্রেন ব্যবস্থা টোকিও থেকে ভিন্ন। স্টেশনে থামানো ট্রেনের সব দরজা খোলা থাকে না। যে যার মতো দরজার পাশে লাগানো বাটন টিপে দরজা খুলে তারপর ভিতরে গিয়ে বসে। আমরাও তাই করলাম। গ্রাম এলাকায় এখনো পুরনো দিনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যদিও জাপানের সব এলাকাতেই আধুনিকতার ছাপ রয়েছে তারপরেও কোথাও কোথাও লোক সংখ্যার কারণে আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় মাতেনি। তারই কিছুটা প্রমাণ এই ট্রেন। সময় মতো ট্রেন ছাড়ল। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য বান্দা স্টেশনে। সেখানে গিয়ে দেখি পুরো স্টেশন ফাঁকা। হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী ছিল সেখানে। বলা যায়, পুরো ট্রেনই ছিল ফাঁকা। স্টেশনের ভিতরে দাঁড়িয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করলাম আমাদের আমন্ত্রণকারী সহিদুল হকের জন্য। ভিতরের অস্থিরতা কাটাতে গ্রামের চিত্র পরিলক্ষিত করতে থাকি। মিনিট দশের মধ্যেই সহিদুল হক চলে আসলেন। আমাকে দেখে সহিদ হাসছিলেন আর হাত নেড়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন।

গাড়ি থামাতেই আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। আমি সামনে বসে পায়ের সঙ্গে কোনো রকম কষ্ট হলেও বইয়ের সুটকেস রাখলাম। থাইও আর তার মা ইউকি উঠে বসলে সহিদুল হক গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। শহরের পথ হলেও আমাদের দেশে ঈদের সময়কার ঢাকা শহরের রাস্তার মতো ফাঁকা।

সমতল রাস্তা থেকে নিচের দিকে ঢালু রাস্তায় গাড়ি চলছে। বুঝতে পারলাম পাহাড় থেকে নামছি। কিন্তু কখন যে পাহাড়ে উঠেছিলাম, তা বুঝতে পারিনি। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি সামনে বিশাল ব্রিজের মতো উড়াল রাস্তা। রাস্তার একদিকে পাহাড়ি ঝরনা। গাড়ির শব্দকে ছাড়িয়ে পানির ঝরনার কলকল শব্দ কানে লাগছে। বাইরে বইছে ঠাণ্ডা বাতাস। বড় বড় সবুজ সাকুরা ফুলের গাছের ছায়া ভেদ করে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম ওসিমা ক্যাম্প জো (সাইট) এ। গিয়ে দেখি সেখানে আগে থেকেই লোকজন যে যার মতো তাদের কাজ করছে। একটু দূরে দূরে তাঁবু টানানো। আমার জাপান আসার শুরুর দিকের কথা মনে পড়ে গেল। আমি প্রতি মাসেই শীত বর্ষা গরম সুযোগ পেলেই জাপানিজ বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও চলে যেতাম। সেখানে তাঁবু টানিয়ে রাত কাটাতাম এবং সকালে যত ধরনের ফুর্তি আছে করে নিজেরাই মাছ ধরে তা পুড়ে খেতাম। সহিদুল হক ব্যক্তিগত জীবনে একজন পেশাদারি ফটো সাংবাদিক। ছবি তোলার কাজেই সারা জাপান ঘুরে বেড়ান। এভাবেই কখনো তাঁবু টানিয়ে, কখনো গাড়িতে রাত কাটিয়ে সময় পাড় করেন।

ওসিমা ক্যাম্প জো-এর আবহাওয়া ছিল চমৎকার। ফুরফুরে বাতাস। চারদিকে সবুজ গাছ-গাছালিতে পাহাড় ঘেরা। পাশেই পাথুরে মরা নদী। যে নদীতে কলকলিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার পানি সাগরের উদ্দেশে ধেয়ে চলেছে। আমার দৃষ্টি সবুজ পাহাড়ের ওপর নিয়ে গেলাম। মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল তখন এই সবুজ দেখে। পাহাড়ের ওপর নীল আকাশ, নিচে কলকলিয়ে ধেয়ে যাওয়া নদীর পরিষ্কার পানি। এসব আমার চোখকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আশপাশে অনেক সুন্দরী জাপানিজ মেয়ের সমাগম দেখেও চোখ যায়নি ওদের দিকে। প্রকৃতিই আমায় টানছিল বারবার। আমরা যাওয়ার একটু পরেই বিভিন্ন দেশের প্রবাসী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এসে যোগ হলেন আমাদের সঙ্গে। এদের মধ্যে ইরান, ইন্ডিয়া, মরিশাস, পাকিস্তান, জাপান ও বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। আগত সবাই এখানে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। সবাই সহিদুল হকের পূর্ব পরিচিত।

থাইও দৌড়ে দৌড়ে তার মার কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করেছে। সামনে চলছে বাচ্চাদের চোখ বেঁধে তরমুজ ভাঙার খেলা। আমি ফেসবুকে লাইভ করছিলাম। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ইন্টারনেট খুব ভালো ছিল না। তারপরেও চেষ্টা করেছি কিছুটা হলেও সেখান থেকে (সরাসরি) লাইভ সম্প্রচার করতে। মাছ পোড়ানোর শেষ নেই। খাবারেরও শেষ নেই। আমরা সেখানে পেট পুরে খাবার খেয়ে ঝরনার পানিতে নেমে ছবি তুলছিলাম। পানিতে নেমে আনন্দ করতে করতে সহিদুল হককে বললাম, চলেন এবার অন্য কোথাও যাই ঘুরতে। হাতে সময় যেহেতু আছে, পুরো এলাকা ঘুরে দেখি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বললেন চলেন যাই। পাশেই আধা ঘণ্টা সময় লাগবে যেতে। ওখানেও খুব সুন্দর লেক আছে। জায়গার নাম ছাগামি কো। সহিদুল হক বললেন, পাহাড়ের ওপরে বিশাল বড় লেক। খুব নামকরা। পাহাড়ের ওপর পানি। সেখানে বেড়ানোর জন্য নৌকাসহ আরও অনেক কিছুই আছে। আমি জানি পাহাড়ের ওপর বড় লেকগুলোর কথা। সবখানেই প্রায় একই রকম। এসব লেককে জাপানের ভ্রমণ বিলাসী কিংবা বিদেশি পর্যটকদের জাপানের প্রতি আকৃষ্ট করতেই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা হয়।

যেই কথা সেই কাজ। সব কিছু গুছিয়ে রওনা দিয়েই আবার ভাবলাম পাশে দেখার মতো পুরাতন একটি ঘর আছে সেটি দেখে না গেলে কেমন হয়? তাই দেখে নিলাম। বিশাল বড় বাউন্ডারির মধ্যে সেই ঘর। ঘরটির বয়স প্রায় শোয়া তিনশ বছর। পুরোটা আমাদের দেশের গ্রামে পুরনো দিনের ছনের তৈরি চালার ঘরের মতো। ভিতরে পুরোটা ঘর কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। মেঝেটা জাপানিজ তাতামি (ছন জাতীয় ঘাষের) বা মেট্রেসে ঢাকা। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন সচল রাখা হয় ছাত্রছাত্রী এবং দর্শনার্থীদের জন্য।

ঘরটি দেখে সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তার ওপর দিয়ে বাতাস কেটে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। আশপাশে সবুজ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। থেকে থেকে খোলা আকাশের নিচে চলে আসলে আকাশ দেখার সুযোগ পাই। সহিদুলকে বললাম, কয়েক মিনিট ঘুমিয়ে নিলাম। এক সময় আমাকে ডেকে তুলল। চেয়ে দেখি পানির কিনারায় আমাদের গাড়ি পার্কিং করা। বুঝতে পারলাম আমরা পৌঁছে গেছি বিখ্যাত সেই ছাগামি কো লেকে। ওসিমা ক্যাম্প থেকে ছাগামি কো লেক পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে মাত্র আধা ঘণ্টা। সেখানে গিয়ে এলাকা ঘুরে দেখলাম। ঘাটে বিভিন্ন খাবারের দোকান, আনন্দ করার পরিবেশ এবং কারও জন্য স্যুভিনর কিনে নেওয়ার দোকান। সামনে হাঁটা হাঁটি করে কফির নেশা পূরণ করতে কফি কিনে নিলাম। টোকিও থেকে এর দূরত্ব ৬০ কিমি এবং পোর্ট সিটি ইয়োকোহামা থেকে ৫০ কিমি। ট্রেনে টোকিও থেকে আসতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। অনেকটা আর্টিফিশিয়ালভাবে তৈরি করা হয়েছে এর চারপাশের পরিবেশ। সব ঋতুতেই ভ্রমণ বিলাসীদের আকৃষ্ট করার মতো করে গাছ লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বদলায়। রাস্তার কাছে সারিবদ্ধভাবে সাকুরা (চেরি ফুলের) গাছ লাগানো হয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে চেরি ফুল ফুটে এর এক রকম সৌন্দর্য ছড়ায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় গাছের পাতার রং বদলে হয় লাল, হলুদ, সবুজ। ছেলে-মেয়েরা এখানে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য এবং মাছ ধরতে আসে। কখনো কখনো পুরো লেকের পানিতে নীল আকাশ নেমে আসার মতো রং দেখায়। বছরজুড়ে এখানে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়।

বড় এবং বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট হলেও লোকজন তখন কমছিল। পানিতে আকাশ দেখা যায় না। চারদিকের সবুজ পাহাড়ের সবুজ রংই দেখাচ্ছিল লেকের পানিতে। তার মধ্যে ছোট বড় বেশ কিছু রাজহাঁস আকৃতির বোট নিয়ে পর্যটকরা পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা দিনের জন্য সাড়ে তিন হাজার ইয়েন দিয়ে বোট ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় সেখানে।

বোট যেখান থেকে ছাড়ে বা ভিড়ে সেখানে একটা ছোট দোকান বারের মতো করে সাজানো রয়েছে।

কিছুদূর যেতেই দেখি সূর্য পাহাড় পর্বত ভেদ করে আমাদের দিকে আলো ছড়াচ্ছে। তখন বাজে মাত্র সোয়া ৬টা। তাকিয়ে দেখি স্বাভাবিকের চেয়ে সূর্যকে অনেক বড় দেখাচ্ছে। ভর দুপুরের মতো আলো এবং উত্তাপ দুইই যেন ছড়াচ্ছিল। সন্ধ্যা হতে তখনো প্রায় এক ঘণ্টা সময় বাকি। আমরা চলে গেলাম ছাগামিহারা মসজিদে। মসজিদে তখন কেউ ছিল না। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম আবার সেই দুপুরের জায়গা ওসিমা ক্যাম্প জো-তে। তবে এবার আরও ভিতরে গিয়ে নদী ছুঁয়ে গাড়ি থামানো হলো। সেখানে যেতেই দেখি গাড়ির শব্দে পানির ধারে বসে মাছ ধরার অপেক্ষমাণ কিছু সাদা বক উড়ে চলে যায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে বেড়ে উঠা গাছের দিকে। সেখানে গিয়ে গাছের ঢালে বসে। আমরা তখন তিনজন গল্প করছিলাম আর ছবি তুলছিল থাইও। দূরে কিছু ছেলে মেয়ে পটকা এবং আতশ বাজি ফুটাচ্ছিল। কেউ কেউ আগুন জেলে কিছু পুড়িয়ে খাচ্ছিল। চারদিকে ক্রমেই তখন রাতের অন্ধকার নামছিল। আমরা তৈরি হয়ে গাড়িতে বসলাম। গাড়িতে উঠে সহিদুল অন্ধকারের মধ্যে বন বিড়ালের চোখের মতো আলো জেলে গাড়ি চালিয়ে ছুটল। একসময় আবার গিয়ে পৌঁছলাম ছাগামিহারা মসজিদে। মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত থেকে আবার বাসার উদ্দেশে দিলাম রওনা। সহিদুল আমাদের তার গাড়িতে করে হাসিমতো স্টেশন পর্যন্ত এসে নামিয়ে দিলে পাশেই এক জাপানিজ রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার সারলাম। দ্রুত ডিনার সেরে টিকিট কেটে স্টেশনে ঢুকে পড়লাম। স্টেশনে ঢুকে আবার সেই সকালের মতো করে আমরা ট্রেন বদলে বদলে এসে পৌঁছলাম আমাদের স্টেশন নিশি উরাওয়াতে। ট্রেন থেকে নেমেই সহিদুল হককে ফোন করে জানালাম আমাদের নিরাপদে বাসার কাছে এসে পৌঁছার কথা। সহিদুল শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। আমাদের এই সুন্দর ভ্রমণের দিনটি ছিল রবিবার ২ জুলাই ২০১৭ সাল।

সর্বশেষ খবর