শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
সহকারী পুলিশ কমিশনার ফেরদৌসী রহমান

রাজপথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নারী পুলিশ

রাজপথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নারী পুলিশ

তিনি নারী, জয়িতা, অদম্য, কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত। ট্রাফিক বিভাগের বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ফেরদৌসী রহমান পথ চলছেন দেশসেবার মহান ব্রত নিয়ে। রাজপথে যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন তিনি। ট্রাফিক সামলানোর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজে নারী পুলিশের এই পথচলা নিঃসন্দেহে উৎসাহ জোগায় সর্বত্র। তিনি নিজের পেশার প্রতি সম্মান রেখে দেশ ও জাতির জন্য করে যাচ্ছেন সর্বোচ্চটুকু। তাকে নিয়ে লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি ,ছবি তুলেছেন— সামির খান

 

বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। সে লক্ষ্যেই পড়াশোনা শুরু। তবে মেয়ের মনে সবসময় উঁকি দিত ইউনিফর্ম চাকরি। বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী মেডিকেলে অ্যাডমিশন দেন। সেখানে ব্যর্থ হলেও খুব বেশি মনোক্ষুণ্ন হননি। বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ইংলিশে অনার্স মাস্টার্স শেষে ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া। পুলিশের চাকরিকে প্রথম পছন্দ হিসেবে রাখেন ফেরদৌসী। অতঃপর তদন্ত অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান বর্তমানে ট্রাফিক বিভাগের বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার ফেরদৌসী রহমান।

বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জে তার জন্ম। বাবা-মায়ের চাকরির সুবাদে ছেলেবেলা থেকে বড়বেলা সবই কেটেছে বরিশালে। দুই ভাইবোন ছিলেন বাবা-মায়ের খুব আদরের। চোখের আড়াল হতে দেননি একটি মুহূর্তের জন্য। এমনকি মেয়ে অনার্স পড়তে বরিশালের বাইরে যাবে, একা থাকবে এমনটি মানতে পারেননি বাবা-মা। তাই নিজেদের কাছে রেখে বরিশালে থেকে পড়াশোনা করান। আজ সেই আদরের মেয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছেন পুলিশ বিভাগে চাকরি করার মতো মহান দায়িত্ব।

ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত থাকায় রোদ-বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছেন ফেরদৌসী রহমান। এমন একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের চাকরি বেছে নেওয়ার সময় পরিবার তেমন অমত করেননি। তবে নিজের প্রবল ইচ্ছাতে পুলিশের মতো চাকরি বেছে নেওয়া। বর্তমানে তার চাকরির বয়স সাড়ে পাঁচ বছরের মতো। বসুন্ধরা ৩০০ ফিট থেকে বাড্ডা পর্যন্ত ফেরদৌসী রহমানের ডিউটি জোন। তিনি এই এলাকার ট্রাফিকের তদারকি করেন। চাকরির সুবাদে তাকে কতই না কঠিন মুহূর্তকে মোকাবিলা করতে হয় যখন তখন। প্রতিটি ঘটনায় তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। তবে ফেরদৌসী রহমানের কাছে চাকরি জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমেই বলেন, ‘এতদিনের চাকরির অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল হলি আর্টিজান ঘটনা। পুরো ঘটনাটিই চোখের সামনে ঘটে। সেই রাতে মনে হয়েছিল সিনেমা-নাটকে দেখা রোমহর্ষক কিছু চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে। সেই সময় তিনি ক্রাইম সেকশনের এডমিনে কাজ করতেন। হলি আর্টিজানের খবরটি কানে আসে সন্ধ্যারাতে। নির্দেশ না থাকলেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। আহতদের উদ্ধার করা থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করা, তাদের পাশে থেকে সেবা-শুশ্রূষা করা, সর্বোপরি এমন নির্মম একটি ঘটনা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার মতো মানসিক বল তার মধ্যে ছিল। এই ব্যাপারটি এখনো মনে করলে শিহরিত হন বার বার।’

ঢাকা শহরের অসহনীয় মাত্রার যানজট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি শহরে যানবাহন সঠিকভাবে চলাচলের জন্য দরকার ২৫ ভাগ রাস্তা। সেখানে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকাতে আছে মাত্র ৭.৫ ভাগ রাস্তা। এদিকে গাড়ির পরিমাণ আছে ৪ গুণের বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশ গাড়ি মেয়াদবিহীনভাবে চলাচল করছে। সেগুলো দেখার কেউ নেই। এর ওপর বাড়তি চাপ হিসেবে আছে সারা বছরই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। এতে করে যে রাস্তা আছে তাও হয়ে যাচ্ছে সংকীর্ণ। সঠিকভাবে চলাচল করতে না পারায় যানজট লেগেই থাকে। রাস্তায় বের হলে কিছু দূর পরপরই সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলা থাকে। তার জন্যও রাস্তা অনেকটা ব্লক হয়ে থাকে। আসলে আমাদের নগর পরিকল্পনায় এবং কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের যতগুলো প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। যে যার মতো কাজ করায় কোনোকিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে না। ফলে যানজট লেগেই থাকে। এর ওপর বাড়তি ঝামেলা হিসেবে কাজ করে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। তারা ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে মানেন না। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা, সিগন্যাল না মেনে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া এবং অধিক সংখ্যক প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহারে এই সমস্যা প্রকট হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সরকারিভাবে যদি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর বিধিমালা আরোপ করা যায় তবে সুফল আসবে। সিটি সার্ভিসগুলোর মান বাড়াতে হবে। কখনো দেখা যায় একটি পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের জন্য একটি করে গাড়ি। এক্ষেত্রেও কিছু সীমাবধ্যতা রাখা গেলে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমবে। এতে করে রাস্তায় যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। তা ছাড়া সবার সমন্বয় মূলক কাজ যানজট কমাতে সক্ষম হবে।

সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কর্তব্য পালনে ব্যয় করতে হয় ফেরদৌসী রহমানকে। মাঝে মাঝে এর থেকেও বেশি সময় দিতে হয়। রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করাটা কষ্টের মনে হয় না? এমন প্রশ্নের জবাবে মৃদু একটি হাসি দিয়ে বলেন, ‘কর্তব্য পালনই আমার কাছে জরুরি। কষ্ট হলেও সঠিকভাবে তা পালন করাকে আমার প্রধান দায়িত্ব মনে করি।’

ইউএস অ্যাম্বাসিতে কর্মরত স্বামীও মেনে নিয়েছেন স্ত্রী ফেরদৌসী রহমানের এই ব্যস্ততা। তবে তার মাঝেও নিজেদের বিনোদনের জায়গাটা ঠিকই বের করে নেন। সময় পেলেই দুজন মিলে গল্প করা, গৃহস্থালি কাজ করা আর মজার রান্না করা তাদের পছন্দ। দায়িত্বের কারণে ছুটি মেলে কম। সামাজিক উৎসবেও আয়োজন করে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না। তবে সুযোগ পেলে কোথাও ঘুরতে যান। কোনো বৃষ্টির রাতে ঘরে ফিরে হয়তো ভাজি, ভর্তার সঙ্গে খিচুড়ি রান্না করে চমকে দেন স্বামীকে।

তার মতে, আনন্দ উপভোগের জন্য আলাদা করে সময় আমাদের কাছে ধরা দেয় না। ব্যস্ততার মাঝেই সময় করে নিতে হয়। তবে পরিবারের শতভাগ সমর্থন থাকায় আমি আমার চাকরি করতে পারছি। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তিনিও মেনে নিয়েছেন আমার চাকরির ব্যস্ততাকে।

পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আগের তুলনায় লেডি অফিসার বাড়ছে। দায়িত্ব নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে কোনো অংশে তারা পিছিয়ে নেই। সহকর্মীরাও সহায়ক ভূমিকা রাখেন। ফেরদৌসী রহমান বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে মেয়েরা লেখাপড়ায় খুব ভালো করছে। এসএসসি, এইচএসসিতে তাদের ভালো রেজাল্ট। কিন্তু জব মার্কেটে তাদের অংশগ্রহণ কম। আমি চাই তাদের অংশগ্রহণ বাড়ুক। অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেই কিছু করুক। আজকের দিনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়াটা সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই কোনো মেয়ে পুলিশে যোগ দিতে চাইলে অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাই। তবে প্রথমে তাকে কাজের প্রতি নিবেদিত হতে হবে এবং ত্যাগের মানসিকতা নিয়েই আসতে হবে। তা ছাড়া আমাদের বদলির চাকরি, কঠোর পরিশ্রমেরও— এগুলো মাথায় নিয়েই কাজে যোগ দিতে হবে। মেয়েরা আজকাল পুলিশে ভালো করছে। ভালো কিছু করলে তার জন্য পুরস্কার ও প্রশংসা সবই মেলে। তাই ক্যারিয়ার ও দেশ সেবার মনোভাব থাকলে পুলিশে আসার সিদ্ধান্ত আমার কাছে উত্তম।

 

 

কর্তব্য পালনই আমার কাছে জরুরি। কষ্ট হলেও সঠিকভাবে তা পালন করাকে প্রধান দায়িত্ব মনে করি

আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। বিষয়টি নিয়ে ফেরদৌসী রহমান নিজেও বিব্রত। তিনি বলেন, ‘আমি একজন নারী ও পুলিশ অফিসার হিসেবে বলতে চাই, মেয়েদের সচেতন হতে হবে। অতি আবেগের জায়গা থেকে বেরিয়ে না এলে সমস্যা চলতেই থাকবে।’ তার পরামর্শ, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেয়েদের আন্তরিকতার সঙ্গে মিশতে হবে। পরিবারেরও উচিত তাদের প্রতি আন্তরিক হওয়া। একটি মেয়ে যখন বড় হচ্ছে, তার চলাফেরা বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে পরিবারের উচিত খোঁজখবর নেওয়া। তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করলে অনেকটাই ঝামেলামুক্ত থাকা যাবে। বাইরের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে ফ্রি হয়ে যাওয়া উচিত নয়, যা একটি মেয়ের দুর্বলতার কারণ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েরা এখনো ছেলেদের ওপর নির্ভর করেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে নিজেদের ওপর নির্ভরশীল হতে শিখতে হবে। নিতান্ত যদি সমস্যায় পড়েই যায় ভিকটিম মেয়েটির উচিত সংশ্লিষ্ট প্রধানের সহায়তা নেওয়া। বাংলাদেশের আইন এখন অনেক সহায়ক। তাদের যে কোনো ধরনের সমস্যায় আইন পাশে আছে।

তিনি আরও বলেন, আগের দিনে মেয়েরা নির্যাতন বলতে শুধু শারীরিক আঘাতকে বুঝত। কিন্তু বর্তমানে আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে, তা হলো মানসিক নির্যাতন। বুঝতে শিখেছে শারীরিকের বাইরেও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা। তাই আমাদের উচিত আগে নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একইভাবে পারিবারিক সম্প্রীতি বাড়ানোর প্রতি তাগিদ দিয়ে বলেন, আজকে আমাদের ছেলেরা নানা রকম সামাজিক অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা, নেশা, সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তাই প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত কর্মব্যস্ততার মাঝেও সন্তানকে সময় দেওয়া। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। এতে তারা নিঃসঙ্গ হয়ে বাইরের জগতে ঝুঁকবে না।

সর্বশেষ খবর