শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
নেত্রকোনার ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য

৬৬-তে ১৪৬ কিমি সাঁতার

৬৬-তে ১৪৬ কিমি সাঁতার

ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। বয়স ৬৬ বছর। নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধা এই বয়সে এসেও নিলেন দূরপাল্লার সাঁতারের চ্যালেঞ্জ। দুই রাত দুই দিন কংশ নদে সাঁতরান তিনি। তার অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানল বয়স। ৬৬ বছর বয়সে তিনি একটানা ৪৩ ঘণ্টা সাঁতরে পাড়ি দিলেন ১৪৬ কিলোমিটার। লিখেছেন— আলপনা বেগম

 

৬৬ বছর বয়সে এসেও ১৪৬ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতার কেটে তাক লাগানোর পরেও অতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। ছেলেবেলা থেকেই সাঁতারে পারদর্শী এমনটাও নয়। অন্যজনের সাঁতার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কলেজে পড়ার সময় অনুশীলন করতে করতে দেখিয়ে দিলেন জয় করা কাকে বলে?

তিনি টার্গেট করেছিলেন ১৮৫ কিলোমিটার পারি দিয়ে আমেরিকার ডায়না নায়াদের ১৭৭ কিলোমিটারের রেকর্ড ভাঙবেন। সেই স্বাদ পূরণ হলো না তার। যে কারণে ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ রয়েই গেল। গত ২০১৫ থেকে লাগাতার চেষ্টা করেও সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। অবশেষে নিজ উদ্যোগে এলাকাবাসী ও ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় দেখিয়ে দিলেন অদম্য ইচ্ছা শক্তি বয়সকেও হার মানায়।

 

উৎসাহ :

১৯৭০ সালে তিনি যখন সিলেট বিএসসিতে অধ্যয়নরত, তখন ধূপাদিঘী পুকুরে সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দীর ৩০ ঘণ্টার অবিরাম সাঁতার দেখে অনুপ্রাণিত হন। এরপর সিলেট চালী বন্দর ছরার পাড়ে সর্বোচ্চ একটানা ৫ ঘণ্টা করে সাঁতর চর্চা করেন। ৫ ঘণ্টার পর তিনি বর্তমান সিলেট এমসি কলেজের হোস্টেল পুকুরে ১০ ঘণ্টা চর্চা করে সফল হন।

 

একক সাঁতার :

১৯৭০ সালে নিজ উপজেলায় মদন চেয়ারম্যানের কাছে ১৫ ঘণ্টার সাঁতার করার জন্য আবেদন করেছিলেন। সে সময় চেয়ারম্যান তার আবেদনে সাড়া দিয়ে জাহাঙ্গীরপুর ভেনাস ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগ নেন। একই বছরের ২৯ নভেম্বর তিনি ১৫ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার প্রদর্শন করে জীবনের প্রথম মদনবাসীর হৃদয়ে জায়গা করেন নেন। এরপর সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে সিলেট বঙ্গবীর ক্লাব ও পদার্থবিদ্যা সরকারি কলেজ বিভাগের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২ অক্টোবর দ্বিতীয় বারের মতন ৩৪ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটেন। একে একে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সুনামগঞ্জের সরকারি হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড  সৃষ্টি করেন। জাতীয় রেকর্ড করায় সেই দিন পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ আনন্দ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর বিকাল ৪ ঘটিকা থেকে শুরু করে ১৯ তারিখ ভোর ৪টা ৫ মিনিট পর্যন্ত জগন্নাথ হলের পুকুরে ১০৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে আবারও নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করেন।

এ ছাড়াও তিনি অষ্টম প্রদর্শনীতে ১৯৭৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে স্টেডিয়াম সুইমিং পুলে ৭৯ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আবার জগন্নাথ হলের পুকুরে জগন্নাথ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় ১০ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের সাঁতার প্রদর্শন করেন। দশম প্রদর্শনীতে ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট নিজ এলাকার মদন পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মদন উপজেলা পরিষদ পুকুরে ১৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করেন। ২০১৪ সালে নেত্রকোনা মিউনিসিপ্যালেটি পুকুরে ২৪ ঘণ্টা সাঁতার কেটে ১১তম প্রদর্শনীতে নিজ জেলা ছাড়াও সারা বাংলাদেশে আলোচিত হন।

 

দূরপাল্লার অবিরাম সাঁতার :

শুধুমাত্র দেশেই নয়, দেশের বাইরেও এই সাঁতারু খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের ভগিরথী নদীতে ৭৪ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারে তিনি ৯ম স্থান অধিকার করেন। ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদ বহরমপুর (জঙ্গিপুর হতে গোদারীঘাট পর্যন্ত) সাঁতারে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। এরপর ১৯৮১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মগড়া নদীতে ৫০ মাইল দূরপাল্লার একক সাঁতারে অংশ নেন। নেত্রকোনার কালীবাড়ি ঘাট হতে মদন জাহাঙ্গীরপুর ঘাট পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন ও সিপিবি’র ব্যবস্থাপনায় ১৬ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করেন।

 

সর্বশেষ অর্জন :

ময়মনসিংহের ফুলপুর কংশ নদের ঠাকুর বাঘাই ঘাটের সরচাপুর থেকে গেল ৪ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ১৪৬ কি.মি. দূরপাল্লার সাঁতার শুরু হয়। অবিরাম ৪৩ ঘণ্টা সাঁতরিয়ে ৬ আগস্ট রবিবার দুপুরে ১টা ৫০ মিনিটে নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া ব্রিজে থামেন। এ সময় এলাকার লাখো জনতা তাকে উৎসাহ দিয়ে পানি থেকে বরণ করে নেন।

 

যত সম্মাননা :

সাঁতারে অনন্য এই মানুষটি জীবনে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গণভবনে রুপার নৌকা পুরস্কার পান। ডাকসু কর্তৃক সম্মাননা সূচক স্বর্ণপদক, ১৯৭৫-৭৬ এ দুবার জগন্নাথ হল কর্তৃক সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক পান। এভাবে ২১টির মতো সংবর্ধনা, স্বর্ণপদক, চেক, নগদ টাকাসহ বিভিন্ন পদক প্রাপ্ত হন। এ ছাড়াও ৮২ ঘণ্টার অবিরাম সাঁতারে রেকর্ড সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট এমসি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে সাঁতার আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা হয়।

১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল পুকুরে অবিরাম ১০০ ঘণ্টার সাঁতার অতিক্রমের পর প্রাধ্যক্ষ ড. রবিন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর কতৃক স্বর্ণপদক প্রদান এবং স্মারকফলক নির্মাণের ঘোষণা হয়। ২০০০ সালে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য্যের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে স্মারকফলকটি পুকুরের পূর্বপাড়ে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে প্রাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. অজয় কুমার দাস স্মারকফলকটি সংস্কার এবং অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন। অবশেষে তিনি কংশ নদে ৬৬ বছর বয়সে ৪৩ ঘণ্টায় বিরামহীন ১৪৬ কিলোমিটার সাঁতার প্রদর্শন করে তাক লাগিয়ে দেন। ৪ জুলাই ৬টা ৫০ মিনিটে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার গেয়াতলা ঠাকুর বাঘাই ঘাট সরচাপুর কংশ নদে সাঁতার শুরু করেন। দুই রাত দুই দিন পর রবিবার ১টা ৫০ মিনিটের সময় নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া নদীর দেওয়ান বাজার ঘাটে এসে পৌঁছেন। এ সময় হাজার হাজার জনতা নদীর দুই তীর ধরে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানায়। অনেকে শত শত মানুষ নৌকা ভাড়া করে নদীতেও ভিড় জমায়। ফুলপুর থেকে মদন পর্যন্ত লাখো জনতা বিভিন্ন উৎসাহ প্রদান করে।

 

বড় মনের মানুষ :

১৯৭৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বন্যার্তদের সাহায্যার্থে ডাকসুর উদ্যোগে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট সাঁতার প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের ১ হাজার ১ টাকার চেক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট দিয়ে দেন।

 

১৯৫২ সালে নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে ২৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা পুরোটাই কেটেছে নিজ গ্রামে। ১৯৬৭ সালে জাহাঙ্গীরপুর টি আমিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি-তে কৃতকার্য হন। এরপরে সিলেট সরকারি কলেজে বিএসসি পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন। হৈ হুল্লোরের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের তুরায় ১১ নম্বর সেক্টরে এক মাস হাতিয়ার চালনার প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বিএসসি পাস করে ১৯৭৫ সালে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি করে ১৯৭৯ সালে তিনি এমএসসি (ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স) সমাপ্ত করেন। ১৯৮০ থেকে ৮১ পর্যন্ত তিনি শেরেবাংলা আবহাওয়া অধিদফতরে এনএসটি ফেলোতে যোগদান করেন। ১৯৮২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি সাবেক ডিসিএ (বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) সহকারী এরোড্রাম অফিসার পদে যোগদান করেন। ২০১১ সালের ২২ মে উপপরিচালক, এরোড্রাম পদ থেকে অবসরে আসেন। এরপর ২০১২ সালের ৬ জুন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে এএনএস কনসালটেন্ট হিসেবে যোগদান করে এখনো পর্যন্ত রয়েছেন।

ছাত্রজীবন থেকেই ইচ্ছে থাকলেও ৬৬ বছর এসে    সেই অবিরাম সাঁতারের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হন ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর