শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
মোহাম্মদ বাজিক

মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের অবলম্বন

সাইফ ইমন

মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের অবলম্বন

আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস প্রবাসী মোহাম্মদ বাজিক। মানব ইতিহাসে তার মতো মানুষ ক্ষণজন্মা। মানবতার পতাকা রচিত হয় মোহাম্মদ বাজিকের মতো মানুষদের হাতেই। অসহায় মৃত্যুপথযাত্রী যেসব শিশুর কেউ নেই তাদের পরম মমতায় বুকের মধ্যে আগলে রাখেন তিনি। ভালোবাসা-আদরে ভরিয়ে রাখেন এসব শিশুর শেষের দিনগুলো। 

 

নিঃসন্তান হওয়ায় বা নিঃসঙ্গতা কাটাতে সন্তান অনেকেই দত্তক নিয়ে থাকেন। অনেকে অবশ্য শুধুই মানবতার খাতিরেও সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। পৃথিবীজুড়ে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা অসহায় মানুষের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসী লিবিয়ান-আমেরিকান নাগরিক মোহাম্মদ বাজিক তেমনই একজন। তিনি সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। তবে তার দত্তক নেওয়ার ব্যাপারটিকে অন্য একপর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি শুধু বেছে বেছে সে ধরনের শিশুদেরকেই দত্তক নেন যাদের মৃত্যু নিশ্চিত। চিকিৎসকরা যাদের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তাদের কোলে তুলে নেন এই মহীয়সী ব্যক্তিত্ব। মোহাম্মদ বাজিকের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা লিবিয়াতে। ১৯৭৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উদ্দেশে তিনি আমেরিকায় যান। এরপর তিনি সেখানেই এক আমেরিকান নারীকে বিয়ে করেন এবং ১৯৯৭ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকাতেই স্থায়ী হন। আমেরিকায় যাওয়ার আগে বাজিক ম্যারাথন দৌড়বিদ ছিলেন। তবে দৌড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও বর্তমানে তিনি অন্য এক প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিনি বিশ্বের খুব অল্প সংখ্যক মানুষদের মধ্যে একজন, যারা তাদের জীবন নিয়োজিত করেছেন শুধুমাত্র মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদেরকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করার কাজে। এবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বলেন, যখন পিতামাতারা জানতে পারে, যে তাদের সন্তান অক্ষম বা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তাদের দেখাশোনা করার সামর্থ্য রাখে না। তারা তাদের সন্তানদের ফস্টার হোমে স্থান দিতে বাধ্য হয়। তারা সন্তানদেরকে হাসপাতালে অথবা কেয়ার গিভিং ফ্যাসিলিটিতে প্রেরণ করে, যেখানে শিশুদের দেখাশোনা করা হয় ঠিকই, কিন্তু তারা তাদের পরিবারের আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়।

মোহাম্মদ বলেন, পৃথিবীতে এই শিশুদের খুব বেশি আপনজন নেই। কিন্তু তাদের এরকম অসহায় অবস্থায় আত্মীয়স্বজনের সংস্পর্শ খুবই প্রয়োজন। তাই এ ধরনের শিশুদেরকেই    মোহাম্মদ দত্তক নেন, যেন তারা পরিবারের আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত না হয়। যখন তারা মৃত্যুবরণ করে, তখন যেন তারা তাদের নতুন পরিবারের পাশে থেকেই মৃত্যুবরণ করতে পারে। সব সময়ই যে এ ধরনের শিশুরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল পিতামাতার সন্তান হয়, এমন না।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের পিতামাতা হয়তো অপরাধী, অথবা নেশাগ্রস্ত। কিন্তু মোহাম্মদের কাছে সবাই সমান। দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সাদা-কালো, আমেরিকান-অ্যারাবিয়ান, মুসলমান-খ্রিস্টান কিছুই বিবেচনা করেন না। মানবতাই তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। একজন মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষের বিপদে সাহায্য করাটাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত    মোহাম্মদ এরকম ৪০ জনেরও বেশি শিশুকে দত্তক নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১০ জন তার হাতের ওপর দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মোহাম্মদের হাতে প্রথম শিশুর মৃত্যু হয় ১৯৯১ সালে। কন্যা শিশুটি আক্রান্ত হয়েছিল তার কৃষিজীবী মায়ের ছিটানো কীটনাশক স্প্রে দ্বারা, যেটা তার মেরুদণ্ডকে এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে, তাকে সব সময় বিশেষভাবে তৈরি কাঠামোর পোশাক পরিধান করে থাকতে হতো। মাত্র এক বছর মোহাম্মদের আশ্রয়ে থাকার পর সে মৃত্যুবরণ করে। আরেকজন পুত্র শিশু ছিল, যে জন্ম থেকেই আক্রান্ত ছিল। তার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তাকে ১৬৭ বার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। মাত্র আট বছর বয়সেই সে মারা যায়। মোহাম্মদের ভাষায়, কিছু কিছু শিশুর মৃত্যু তাকে খুব বেশি আঘাত করে। কয়েকজনের ক্ষেত্রে তাকে তিন দিন পর্যন্ত কাঁদতে হয়েছিল। কিন্তু এই আঘাত সত্ত্বেও তিনি নতুন আরেকটি শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হন না। এই মুহূর্তে মোহাম্মদের সঙ্গে দত্তক নেওয়া সন্তানদের মধ্যে আছে ছয় বছর বয়সী পালিত কন্যা, যে মাইক্রোসেপলি নামক বিরল ধরনের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, যে রোগের ফলে শিশুটির মস্তিষ্ক এবং শরীর সুগঠিত হতে পারেনি। ফলে মেয়েটি দেখতে কিংবা শুনতে পায় না এবং তার হাত ও পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দিনের মধ্যে ২২ ঘণ্টাই তাকে টিউবের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাবার গ্রহণ করতে হয়। তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হওয়ায় মোহাম্মদকে প্রায় প্রতি রাতেই মেয়ের কাছে সোফাতে ঘুমাতে হয়, যদি রাতের বেলা হঠাৎ জরুরি প্রয়োজন হয়, সেই ভয়ে।

মোহাম্মদ জানেন, মেয়েটি শুনতে পায় না। কিন্তু তারপরেও তিনি তার সঙ্গে অবিরত কথা বলেন, তার হাত ধরে বসে থাকেন, তার সঙ্গে খেলেন। তিনি বলেন, সে হয়তো শুনতে পায় না, কিন্তু স্পর্শ তো অনুভব করতে পারে! তার তো প্রাণ আছে, সে-ও তো মানুষ। পিবিএস ডকুমেন্টারি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বলেন, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদেরকে দত্তক নেওয়া এবং তাদের দেখাশোনা করা অত্যন্ত কষ্টকর কাজ। তিনি জানেন, এই শিশুরা বেশিদিন তার সঙ্গে থাকতে পারবে না, তাদের আয়ুষ্কাল সীমিত এবং এদের মৃত্যু বারবার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করবে। কিন্তু তারপরেও তিনি তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। তার ভাষায়, একে অন্যকে সাহায্য করাই তো মানুষের কর্তব্য। মোহাম্মদ বাজিক একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। তিনি বলেন, এই শিশুদেরকে দত্তক নেওয়ার মতো কষ্টকর কাজে তিনি অনুপ্রেরণা পান তার ধর্মবিশ্বাস থেকে। একজন মুসলমান হিসেবে অন্য একজনের বিপদে সাহায্য করা তার কর্তব্য। তার মতে, মৃত্যু জীবনের অংশ। কিন্তু এই শিশুগুলো, যাদের দেখাশোনার জন্য কেউ নেই, তাদের মৃত্যুর আগে কিছুদিন দেখাশোনা করা, ভালোবাসা দেওয়া, এই কষ্টকর সময়টুকুতে তাদের পরিবারের অভাব বুঝতে না দেওয়া এটাই তাকে সবচেয়ে বড় আনন্দ দেয়। অন্যদের দেখাশোনা করা মোহাম্মদের নিজের জীবন কিন্তু নিষ্কণ্টক না। তার নিজের সন্তান, আদম, যার জন্ম ১৯৯৭ সালে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার হাড় অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং তার শারীরিক বৃদ্ধিও সীমিত। মোহাম্মদের স্ত্রী সব সময় তার সঙ্গে শিশুদেরকে দেখাশোনা করতেন। তার স্ত্রী ২০০৫ সালে মারা যান। সেই থেকে দত্তক নেওয়া শিশুদের একাই দেখাশোনা করেন। গত বছরের নভেম্বরে মোহাম্মদ জানতে পারেন, তিনি নিজেই কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তার যখন তাকে জানান, শিগগিরই অপারেশন করতে হবে, তখন তিনি প্রথমে রাজি হননি। কারণ তিনি হাসপাতালে গেলে তার ছেলে এবং পালিত কন্যাদের কে দেখাশোনা করবে। পরে অবশ্য তিনি অপারেশন করান।

সর্বশেষ খবর