শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে তনিমার ফার্স্টক্লাস

তানিয়া তুষ্টি

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে তনিমার ফার্স্টক্লাস

মায়ের সঙ্গে তনিমা। ছবি তুলেছেন— রাশিফুল আলম চমক

সিরাজগঞ্জের মেয়ে তাহসিন কামাল তনিমা। তিনি সম্প্রতি এলএলবিতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর বাংলাদেশ শাখায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার প্রায় শেষ পর্যায়। তিনি চান দেশের জন্য কাজ করতে

 

পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করা সত্যিই খুব সাধনার। আপনি সেখানে সফল, কীভাবে সম্ভব হয়েছে? জবাবে, আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ায় চাপ কম ছিল। তবে সারা বছর পড়াশোনার সঙ্গে মোটামুটি যোগাযোগ থেকেছে। আর ভালো রেজাল্ট করতে কখনো মুখস্ত বিদ্যাকে গুরুত্ব দেয়নি। যে টপিকগুলো পড়ছি তা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়াও একটি বিষয়ে ভালো উত্তর দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পড়তাম। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমার লেখায় উল্লেখ করেছি। তবে শুধু ভালো ফলাফল নয়, কোনো বিষয়ে ভালোভাবে বুঝতে যথেষ্ট পড়াশোনার বিকল্প নেই। আপনি যে বিষয়ে ভালোভাবে জানতে চান সে বিষয়ে অবশ্যই পড়তে হবে। ভালো ফলাফলের জন্য আমার মাও কখনো চাপ দিতেন না। তবে পড়ালেখার ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলেছেন যথেষ্ট। আমার মধ্যে পড়াশোনার তাগিদ সৃষ্টি করেছেন

 

 

ছোটবেলায় ভালো ফলাফল করলেও বড় হয়ে সেটা ধরে রাখা কঠিন। তখন প্রতিযোগীর সংখ্যা বাড়ে আবার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রও বাড়ে। অনেক সময় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয় বিদেশি সহপাঠীর সঙ্গে। সব মিলিয়ে ভালোভাবে টিকে থাকা এবং সেরা ফলাফল করে দেশের গৌরব অর্জনের একটি পালক জুড়ে দেওয়া নিতান্তই সহজ কথা নয়। যথেষ্ট একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। এক কথায় দেশ ও জাতিকে এভাবে গর্বিত করা বড় ধরনের সফলতা। আর সে সফলতা এসেছে তাহসিন কামাল তনিমার হাত ধরে। তনিমা এলএলবিতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর বাংলাদেশ শাখায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

সচারচার এমন ফলাফল দেখা যায় না। দীর্ঘ ১০ বছর পর বাংলাদেশের এমন প্রাপ্তি এসেছে বলে জানা গেছে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এলসিএলস(এস) বাংলাদেশ শাখার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। তনিমার এমন কৃতিত্বের জন্য যুক্তরাজ্য  ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামের ডিরেক্টর সাইমন অ্যাসকি বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান। এর আগে ২০০৭ সালে একজন ছেলে আইন বিষয়ে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলেন।

সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার নেওয়ারগাছা গ্রামের মেয়ে তাহসিন কামাল তনিমা। মা বিএনপি-এর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সিমকি ইমাম খান। বাবা পিডব্লুউডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কালাম পাশা। চার বোনের মধ্যে তনিমা তৃতীয়। ছোটবেলা থেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষমেশ মায়ের পথে হাঁটা। মা খুবই ব্যস্ত থাকেন নিজের নানা রকম কাজ নিয়ে। একই সঙ্গে বাসা সামলানো এবং সবগুলো বোনকে সমান মমতা দিয়ে বড় করে তোলার ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেননি আমার সুপারমম। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। মা যেহেতু এই পেশায় আছে তাই আগ্রহটা একটু বেশি। আইন বিষয় নিয়ে পড়তে এসে দেখলাম এটা খুবই উপভোগের। অনেক কিছু জানার আছে অনেক বোঝার আছে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাবলীলভাবে বলে চললেন তনিমা। সাধারণ মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছায় তার পড়ালেখা আরও গুরুত্ব পেয়েছে। ২০১৭ সেশানে পাস করলেন তনিমা। এমন একটি অর্জনের অনুভূতি খুবই আনন্দদায়ক বলে জানালেন তিনি। পরীক্ষা দিয়ে ভালো একটি ফলাফলের আশা করেছিলেন, কিন্তু এতটা ভালো হবে ভাবতেও পারেননি।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে ২০১১ সালে ‘ও’ লেভেল (অর্ডিনারি লেভেল) এবং ২০১৩ সালে ‘এ’ লেভেল (অ্যাডভান্স লেভেল) পাস করেন বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে। দুটিতেই এ গ্রেড পেয়ে পেয়েছিলেন তনিমা। ছোট থেকেই নাচ, গান, কবিতা, আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। বড় হওয়ার পর এগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখলেও পড়ালেখার পাশাপাশি মনোযোগী হয়েছেন বাবা ও মায়ের সঙ্গে নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজে।

বাবার হাতে গড়া একটি এনজিওতে প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে আছি। সেখানে কিছু কাজ করতে হয়। মায়ের সঙ্গে নিজ এলাকায় মানবসেবা মূলক বিভিন্ন কাজে সঙ্গে থাকি। তনিমার কাছে জানতে চাওয়া হলো পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলো করতে তার কেমন লাগে। চোখেমুখে দীপ্ততা নিয়ে বলে চললেন, ‘মায়ের মতো সবার জন্য কাজ করতে চাই। দেশকে অনেক ভালোবাসি। বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও দেশে করেছি’। 

তনিমার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশেই বসেছিলেন মা সিমকি ইমাম খান। নিজের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে সন্তানের আদর ভালোবাসা সবচেয়ে আগে। তিনি বলেন, ‘কখনো আমার মেয়েদের পড়াশোনার জন্য চাপ দেইনি। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতাম। তারা যেন নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে শিখে যায়। আমার কাছে ক্লাসে ভালো ফল করায় বড় কথা না। একজন ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠা, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার মানসিকতা তৈরি হওয়াটা বড়। ব্যারিস্টারি শেষ করে সে দেশের মানুষের জন্য কিছু করুক— এটাই চাই’।

এতগুলো দায়িত্ব যার কাঁধে তার কাছে পুরো ব্যাপারটিই কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু তনিমা বললেন, আসলে আমার কাছে তেমন কিছু মনেই হয় না। আমি আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি। বাইরের দেশের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ অনুভব করি না। পরিবার থেকেই যেহেতু শিক্ষা ছিল, আর এখন আমি নিজেই দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করি। আমি চাই, আমার মতো তরুণরা দেশের জন্য ভালোবাসাটা অনুভব করুক। তারাও চেষ্টা করুক দেশের জন্য নতুন কিছু করার।

‘পরীক্ষার ফলাফল পেলাম মাত্র। দেশে এক বছর ইন্টার্ন করব। এরপর বার-এট-ল ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে ফিরে আমি আমার পেশায় পুরোপুরি নিয়োজিত হওয়ার আশা রাখছি। নিজের কাজের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যত ধরনের সেবামূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করা যায় তার প্রতি কার্পণ্য থাকবে না। আমার ভালোটা দেশকে দিতে চাই।’ এমনটাই প্রকাশ করলেন তিনি।

সর্বশেষ খবর