শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট

সাইফ ইমন

সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট

থ্রিডি প্রিন্টিং থেকে স্টিও কাটিং, কাপড় কাটিং, গ্রাস কাটিং প্রভৃতি কাজে সক্ষম মেহেদী হাসান সম্রাটের তৈরি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট

মেহেদী হাসান সম্রাট। জন্ম ১২ মে ১৯৮৬ সালে ফরিদপুর জেলা সদরের পূর্ব খাবাসপুরে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পাস করেন ফরিদপুর সদরের বায়তুল মোকাদ্দেস ইনস্টিটিউট থেকে। ছোটবেলা থেকেই সম্রাট ছিলেন অতিরিক্ত শান্ত প্রকৃতির। বই পড়ার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। মূলত ক্লাসের বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে কমিক্স পড়া থেকেই বই পড়া শুরু। ক্লাসে ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিলেন না। কারণ গতানুগতিক ধারার লেখাপড়া মোটেই পছন্দ ছিল না সম্রাটের। ক্লাসের বই থেকে অন্যান্য বইয়ের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ।

ছোটবেলায় বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় সম্রাটের বাবার ব্যবসাকেন্দ্র প্রেক্ষাগৃহের নানা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দেখে। তবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে ছোটবেলা থেকেই। সপ্তাহে একদিন প্রচুর পরিমাণে বই ও মার্কেট থেকে ইলেকট্রনিক্স পার্টস সংগ্রহ করতেন। সেগুলো নিয়েই স্টাডি করে কাটিয়ে দিতেন পুরো সপ্তাহ। ইলেকট্রনিক্স সার্কিট ডিজাইনের বই এবং বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজের বই থাকত তালিকায় সবার ওপরে। আর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল সায়েন্স ফিকশন। তখন থেকেই নিজের খেলনাগুলো নিজে তৈরি করে নিতেন সম্রাট। যেমন রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, ডিসি মোটর চালিত স্পিড বোট, মিনি এফ এম ট্রান্সমিটার, শর্টরেন্স ওয়াকি-টকি, মিনি ফ্যান ইত্যাদি।

সম্রাট বলেন, বাবার আর্থিক সমস্যা থাকার কারণে স্কুল জীবনে আমার লেখাপড়া ও  দৈনন্দিন জীবন অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে শেষ করতে হয়। বাবা কখনোই যন্ত্রপাতি ও বিজ্ঞানসামগ্রী নিয়ে কাজ করা পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন এগুলো নিয়ে কাজ করে কি মেকানিক হবা? তাই তিনি সুযোগ পেলে নিউ মার্কেট থেকে আনা পার্টসগুলো ফেলে দিতেন। স্কুলে পড়া অবস্থায় একবার মিনি ট্রান্সমিটার নিয়ে কাজ করার সময় সিগন্যাল পরিবর্তন হয়ে টিভি সিগন্যালে ঢুকে যায়। বাবা তখন খবর দেখছিলেন। তিনি হঠাৎ টিভিতে আমার কণ্ঠ শুনতে পান। বাবা বুঝতে পারেন এবং আমাকে প্রচুর বকা দেন।

স্কুল জীবনেই নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি লুকিয়ে সরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন সম্রাট। আর এটাই তার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক টেকনিক্যাল ট্রেনিং। সম্রাট বলেন, মাধ্যমিক পাসের পর আমি টেকনিক্যাল লাইনে পড়ালেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে বাবা তাতে রাজি না হওয়ায় আমাকে স্বাভাবিক লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার ও মোবাইল সার্ভিসিং করে নিজের খরচ নিজেই বহন করতাম। এই সময়ে আমার সুযোগ হয় বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটি ডিভাইজ যেমন ওয়ারলেস নেটওয়ার্কিং, সিকিউরিটি ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার। এভাবেই আমার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হয় এবং গ্রাজুয়েশন করার জন্য ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হই।

গ্রাজুয়েশনের মাঝামাঝি সময়ে প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যা সৃষ্টির কারণে ঢাকায় গিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হয় আমাকে। এসময় ছয় মাস পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং শেষ করার পর আমি নিজেই ঢাকার উত্তরায় মোবাইল এবং কম্পিউটার শোরুম ও সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করি। এ সময়ই সম্রাট ব্যবসার পাশাপাশি আউট সোর্সিং ট্রেনিং এবং হ্যাম রেডিও বা ওয়ারলেস অপারেটিংয়ের ট্রেনিংয়ে যোগ দেন। এই সময় এনালগ ইলেকট্রনিক্স থেকে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের প্রতি পড়াশোনায় ব্যাপক মনোযোগ দেন সম্রাট। কাজ শুরু করেন মাইক্রোকন্ট্রোলার নিয়ে। আর এভাবেই শুরু হয় তার হাইটেক প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং আইডিয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ।

সম্রাটের বাবা মরহুম শাহাদৎ হোসেন এবং মা সুফিয়া শাহাদৎ। তিন ভাই বোনের মধ্যে সম্রাটই সবার ছোট। বাবা মরহুম শাহাদৎ হোসেন পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এছাড়াও একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সমাজসেবক হিসেবে এলাকায় সুনাম রয়েছে তার। বড় বোন সায়লা ইসলাম নার্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং বড় ভাই শফিউল মঞ্জুর ফরিদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী।

অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে সম্রাট বলেন, শৈশব থেকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন ছোট মামা ফেরদৌস জাহান এ্যাপোলো। তিনি বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতেন এবং আমাকে অনুপ্রাণীত করতেন বিজ্ঞান গবেষণায়। শৈশবে তিনি আমাকে পরিচিত করেন ইলেকট্রনিক্স এবং বিভিন্ন ধরনের সার্কিটের প্রতি। মাইক্রো কন্ট্রোলার নিয়ে কাজ করার শুরুতে তিনি ব্যাসিক প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের ধারণা দেন। কাজের শুরুটা জানতে চাইলে সম্রাট বলেন, শুরুটা সেই ছোটবেলায়ই। তখন থেকেই যন্ত্রপাতির সঙ্গে আমার ভালোবাসা হয়ে যায়।  প্রথম কাজের শুরু বলতে গেলে শৈশবে খেলনা তৈরি থেকেই। এরপর প্রথম হাইটেক ডিভাইস তৈরি শুরু করি ২০০৪ সালে। প্রথম তৈরি করি মোবাইল নেটওযার্ক বেসড সিকিউরিটি এলার্ম। এটি মূলত চুরি হওয়ার মুহূর্তে নির্দিষ্ট কোনো নম্বরে কল দিতে পারত। এটা স্থানীয় বিজ্ঞান মেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে। পরিদর্শনে ছিলেন তৎকালীন দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী। এরপর থেকেই ব্যক্তিগত বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিবিষয়ক ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক্স, সার্কিট ডিজাইন, প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়ার, নেটওয়ার্কিং, মাইক্রো কন্ট্রোলার ডিটেলস ইত্যাদি।

তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাজটি হচ্ছে সিএনসি রোবট। এটি এক ধরনের Computer Numeric Control Robot। এই রোবটটি বর্তমান বিশ্বে মানুষের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের কাজ অনেক নিখুঁতভাবে এবং দ্রুত করতে পারা উন্নত প্রযুক্তির রোবটদের মধ্যে অন্যতম। কাঠের কাজ থেকে শুরু করে থ্রিডি প্রিন্টিং, রোবটিক্স সার্জারি, রিমোটলি যে কোনো সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ, স্টিও কাটিং, কাপড় কাটিং, গ্রাস কাটিং ইত্যাদি যে কোনো কাজেই এটাকে ব্যবহার করা যায়। এই মেশিনের ডিজাইন এবং সব যন্ত্রাংশ সম্রাট নিজের হাতে তৈরি করেছেন। এছাড়াও এতে যুক্ত করেছেন ইন্টারনেটভিত্তিক রিমোট কন্ট্রোল— যেন এটি বিভিন্ন ধরনের গবেষণার কাজেও ব্যবহার করা যায়। পুনরায় কর্মক্ষম করা যায়। আরও রয়েছে যে কোনো ধরনের হেড সংযোজন করার ব্যবস্থা যেমন— লেজার, প্লাজমা কাটার, স্পিনডাল মোটর ফর উড ডিজাইন ওয়ার্ক ইত্যাদি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই রোবট মানুষের জীবনে অনেক বড় অবদান রাখতে পারবে বলে আশাবাদী সম্রাট। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এটি কাজে লাগতে পারে। এই সিএনসি রোবট ব্যবহার করে কাঠের ডিজাইন করার ক্ষুদ্র কারখানা করতে পারবে যে কেউ। আবার মেডিকেল সেক্টরে এই সিএনসি’র উন্নীতকরণের মাধ্যমে সার্জিক্যাল রোবটের ভার্সন তৈরি করাও সম্ভব হবে ভবিষ্যতে। সিএনসি রোবট ব্যবহারের মাধ্যমে যেসব পণ্য তৈরি করা যায় তা অনেক মানসম্পন্ন হয়। ফলে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসম্পন্ন পণ্য গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারে।

আকর্ষণীয় আরও কিছু কাজ করেছেন মেহেদী হাসান সম্রাট। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক বেসড মাল্টি ফাংশন, ভেহিকেল অ্যান্ড হোম সিকিউরিটি ডিভাইস, কম্পিউটার কন্ট্রোল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস ওভেন, ডিজিটাল ওয়াটার পাম্প কন্ট্রোলার উইথ ওবার অ্যান্ড আন্ডার ভোল্টেজ প্রোটেকশন, থারমাল সিকিউরিটি ক্যামেরা এলার্ম, কম্পিউরাইজড পিআইডি কন্ট্রোলড ইউনিভার্সাল টেম্পারেচার কন্ট্রোলার, স্মার্ট ফোন বেইজড আইওটি, রিমোট কন্ট্রোল ফর হোম এপ্লিকেশন, স্মার্ট ফোন অ্যান্ড আইওটি বেইজড সেল্ফ ড্রাইভিং কার ইত্যাদি। এর মধ্যে স্মার্ট ফোন অ্যান্ড আইওটি বেইজড সেল্ফ ড্রাইভিং কারের পরীক্ষামূলক প্রটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। একে যদি আরও উন্নত করা সম্ভব হয়, তবে গুগলম্যাপের সঙ্গে যে কোনো গাড়ি নিজেকে সংযুক্ত করে পথ চলতে পারবে। এখানে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য থাকবে একাধিক সেন্সর এবং উন্নত ইমেজ প্রসেসিং। 

সর্বশেষ খবর