প্রতিদিন কত শত রোগী আসেন যান। কেউ হাসিমুখে ফেরেন, কেউ অপ্রত্যাশিত সত্যের মুখোমুখি হন। সদ্যপ্রসূতি মা ১ ঘণ্টা আগেও হয়তো স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছেন, কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছেন ডাক্তারের হাতের ওপরই। অনেকে ধরে নেন, রোগীর এমন বাঁচা মরাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু কথাটি মোটেও সত্য নয়। অপ্রত্যাশিত এই মৃত্যু ঠেকাতে সবসময় তাড়নায় ভুগতেন অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার। সে তাড়না থেকে আবিষ্কৃত মেথড আজ হাজারো মায়ের জীবন বাঁচিয়ে চলেছে। লিখেছেন — তানিয়া তুষ্টি
গাইনিকোলজিস্ট হিসেবে পেশাজীবনের শুরু। তখন থেকে অনেক মাকে প্রসূতিজনিত রক্তক্ষরণে মারা যেতে দেখেছেন ডা. সায়েবা আক্তার। ভাবতেন, আমার বা আমাদের কি কিছুই করার নেই? তরতাজা প্রাণগুলো আর কত এভাবে ঝরে যাবে চোখের সামনে? মানুষের প্রতি এই মমতা থেকেই আজ সারা বিশ্ব পেল অভাবনীয় এক কার্যকরী পদ্ধতি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাস করার পর সেখানেই প্রথম চাকরি। তারপর আইপিজিএমআর, বরিশাল মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল, সিলেট মেডিকেল এবং সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেলে যোগ দিয়েছেন। সময় ও স্থান বদলালেও মাতৃমৃত্যুর যে চিত্র তা বদলায়নি। বরং ঢাকা মেডিকেলে রোগীর চাপ বেশি থাকায় মাতৃমৃত্যুও তাকে বেশি দেখতে হয়েছে। চোখের সামনে হাজারো মায়ের প্রাণ হারানোর দৃশ্য অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি ছিল। বেশ কিছু বছর আগে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই চিত্র ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল প্রসব পরবর্তী রক্তপাত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় পোস্ট পারটাম হেমোরেজ বা পিপিএইচ। এর চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশের জনগণের জন্য এই ব্যয় বহন করা ছিল কষ্টকর। কখনো কখনো মাকে বাঁচাতে গিয়ে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হতো। সেক্ষেত্রে ওই নারী চিরদিনের জন্য মা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।
২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারকে খুব ভাবিয়েছিল। একবার এক ট্রেনিং প্রোগ্রামে প্রসূতি মায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধে একটি টেম্পোনেডের ব্যবহার দেখেছিলেন তিনি। সেটা ফুলানো কনডমের মতোই। মাত্র একবারই ব্যবহার করা যেত এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ওই পদ্ধতি দেশে চালু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ডা. সায়েবা বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। হঠাৎ মনে হলো কনডম তো একটি এফডিএ অনুমোদিত মেডিকেল ডিভাইস। এটা জরায়ুর ভিতরে ঢুকিয়ে যদি কোনোভাবে ফোলানো যায় তাহলে জরায়ুর দেয়ালে সহজেই চাপ সৃষ্টি করবে। সে চাপে হয়তো রক্তপাত বন্ধ হবে। তাছাড়া আমাদের হাত-পা কেটে গেলেও শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। জরায়ুর ভিতরে বিশেষ ধরনের ওই টেম্পোনেডই কেন লাগবে, কনডম দিয়ে চাপ দিলেও রক্তপাত বন্ধ হতে বাধ্য। যেই ভাবা সেই কাজ, ডা. সায়েবা কনডমের ভিতরে পানি ঢুকিয়ে এর স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষা করলেন। দেখলেন মোটামুটি এক লিটার পানির চাপেও কনডমটি ফেটে যাচ্ছে না।
পরের দিন সকালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য এক নারীর জরায়ু কেটে ফেলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তখন তিনি অপারেশনের বাধা দিয়ে প্রথমবারের মতো কনডম টেম্পোনেড ব্যবহার করলেন। একটি ক্যাথেটারের মাথায় একটি কনডম বেঁধে জরায়ুতে ঢুকিয়ে দেন। তারপর ক্যাথেটার দিয়ে স্যালাইন পুশ করে জরায়ুর মধ্যে কনডমটি ফুলিয়ে তোলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে ১৫ মিনিটের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়েছিল। রোগীটি তার জরায়ুসহ সুস্থভাবে বাড়ি ফিরেছিল। এই পদ্ধতি রক্তক্ষরণ বন্ধে যেমন কার্যকর, তেমনি খরচ খুবই নগণ্য।
প্রথম সফলতা পাওয়ার পর শুরু হলো তার গবেষণা। সমসাময়িক কয়েকজন টিম মেম্বার নিয়ে কাজ শুরু করলেন। ২০০১-২০০২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. সায়েবা আকতারের নেতৃত্বে ২৩ জন রোগীকে এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন। তার এই আবিষ্কার ও গবেষণা ২০০৩ সালে গবেষণা কর্মটি মেডস্কেপ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে এটি অরিজিনাল রিসার্চ পেপার হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনি অ্যান্ড অবসসহ আরও বেশকিছু জার্নালে প্রকাশ পায়। বিশ্বজুড়ে এটি সায়েবা’স মেথড হিসেবে পরিচিতি পায়। ঘটনাগুলো একে একে শোনা গেল ডা. সায়েবার মুখেই। তিনি জানালেন, আন্তর্জাতিক জার্নাল থেকে জানার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার ডাক পড়ে সায়েবা’স মেথড এর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই মেথড নিয়ে এফসিপিএস ডিজার্টেশন, এমএস থিসিস, পিএইচডি থিসিস হয়েছে। তাকে রয়্যাল কলেজ অব অবস অ্যান্ড গাইনোকলজিস্ট থেকে অনারারি ফেলোশিপও দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে যখন মেথডটি আবিষ্কার হয় তখন ডা. সায়েবা এটাকে ‘মেলস কনডম ইন উইমেনস হেলথ’ শিরোনামে উপস্থাপন করেন। কিন্তু পাবলিকেশনের সময় এটাকে সায়েবাস মেথড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। টিমের অন্যান্যদের সহায়তা থাকলেও মূল ভাবনা ছিল ডা. সায়েবার। তাছাড়া বিশ্বের জার্নালগুলো এই পদ্ধতিতে সায়েবাস মেথড নামেই পরিচিতি দিয়েছে।
চলতি মাসের ২ তারিখ বিবিসি একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় অ্যানি মুঞ্জেলা নামে কেনিয়ার একজন মিডওয়াইফ কনডম দিয়ে প্রসব পরবর্তী রক্তপাত বন্ধ করছেন। তিনি তার ক্লিনিকে এই পদ্ধতিতে ছয়জন মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে অনুন্নত দেশগুলোর আরও অনেক মায়ের জীবন বাঁচবে বলে আশা করা হয়। এই আবিষ্কারে তিনি নিজের নামে পেটেন্ট দাবি করলে ডা. সায়েবার বিষয়টি আবার সবার সামনে উঠে আসে। বিগত ১৩ বছরে বিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে সায়েবা’স মেথড। জানতে চাওয়া হলো আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি জানালেন, ‘মা তো মা-ই। সে সাদা হোক আর কালো হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সন্তানের কাছে মা মমতাময়ী আশ্রয়ের নাম। আমি চাই বিশ্বের প্রতিটি মায়ের সুরক্ষায় আমার মেথড ব্যবহার হোক’। তিনি চান না আর কোনো নারী এভাবে মারা যাক। সায়েবাস মেথড প্রয়োগ করা খুবই সহজ এবং দ্রুততার সঙ্গে করা সম্ভব। তবুও অনেকে অনভ্যাসের কারণে অভিযোগ করেন মেথডটি কাজ করছে না। এ জন্য সবার মাঝে আরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তাহলে মেথডটি আরও উপকারে আসবে। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে যে শুধু প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে তা নয়। বহু মায়ের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ২০০৩ সালের আগে দেশে প্রসূতির রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুর হার যে পরিমাণ ছিল এই পদ্ধতি ব্যবহারে তা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। বিশ্বের বহুদেশ এখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশ, আমেরিকাসহ অনেক দেশে এই মেথড ব্যবহার হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়াতে ন্যাশনাল প্রোটোকলের সেকেন্ড লাইন অব ট্রিটমেন্টে সায়েবাস মেথড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
এই মেথড আবিষ্কারের কল্যাণে বহু দেশে গিয়েছি। বহু মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বলা হয়, কার্যকরী এই মেথডের প্রথম আবিষ্কার হয়েছে বাংলাদেশে। ডা. সায়েবা তার আবিষ্কারক। আমার মাধ্যমে আমার দেশকে এভাবে প্রেজেন্ট করার সুযোগটি সবচেয়ে আনন্দের। আমি গর্ববোধ করি, অন্তত দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি— এভাবেই বললেন ডা. সায়েবা আক্তার।