শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফুটপাথের দোকানি থেকে প্রেসিডেন্ট

তানিয়া তুষ্টি

ফুটপাথের দোকানি থেকে প্রেসিডেন্ট

যে পদে আগে কোনো নারী স্থলাভিষিক্ত হননি, এবারই প্রথম। তাও আবার প্রেসিডেন্টের পদ। বিশ্বের দরবারে যখন দেশটির নাম উচ্চারিত হবে তখন তার প্রেসিডেন্টের নামও উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। শুধু কি তাই, ছোটবেলায় বাবা হারা মেয়েটি মায়ের সঙ্গে ফুটপাথে খাবার দোকান চালিয়েছিলেন। অথচ ইতিহাসে আজ তার নাম লেখা হচ্ছে সে দেশেরই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে। পুরো বিষয়টি সে দেশের জন্য তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও  আলোড়িত। সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার ব্যবস্থায় পরিচালিত দেশ সিঙ্গাপুরে সৃষ্টি হলো এমনই ইতিহাস। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ সিঙ্গাপুরে এবারই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হলেন হালিমা বিনতে ইয়াকুব।

সিঙ্গাপুরের অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৪ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নিলেন হালিমা ইয়াকুব। নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে প্রথমবারের মতো একজন মুসলিম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। মালয় সম্প্রদায়ের ৬৩ বছর বয়স্ক এই নারী এর আগে দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের আগের দিন দেশটির প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তার মাধ্যমে জানান, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হালিমাই একমাত্র বৈধ প্রার্থী ছিলেন। বাকি প্রার্থীরা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় হালিমা ইয়াকুবকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়েছে।

 

হালিমার জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৩ আগস্ট কুইন স্ট্রিটে। হালিমা ইয়াকুবের বাবা ছিলেন ভারতীয় ও মা মালয়ী। পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হালিমা। তার যখন আট বছর বয়স তখন বাবাকে হারান। মা হন পুরো সংসারের ভরসা। বাবা সন্তানদের জন্য তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি। সন্তানদের নিয়ে জীবন চালাতে মায়ের হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। তখন উপায়ন্তর না পেয়ে হালিমার মা রাস্তায় অবৈধভাবে দোকান দিয়ে খাবার বিক্রি করতেন। লাইসেন্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ব্যবসা চালাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এভাবে চলতে তাদের খুব কষ্ট হয়েছে হয়তো কিন্তু কখনো কারও কাছ থেকে ধার করতেন না। পরে অবশ্য হকার লাইসেন্স জোগাড় করে নিয়েছিলেন। ছোট্ট হালিমা মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতেন। দোকান পরিষ্কার, বাসনপত্র ধোয়া, টেবিল পরিষ্কার, ক্রেতাদের খাবার পরিবেশনসহ সব কাজই করেছেন জীবিকার তাগিদে। ছোটবেলায় যখন ক্লাসরুমের একদম শেষ বেঞ্চটাতে গিয়ে হালিমা বসতেন তখন কি ভেবেছিলেন জীবনের ইঁদুর দৌড়ে এতদূর এগিয়ে যাবেন? সিঙ্গাপুরের একটি পত্রিকা ‘দ্য নিউজ পেপার’ এর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি কখনো ঠিকমতো হোমওয়ার্ক করে স্কুলে যেতাম না। তা ছাড়া ক্লাসে বসলেই আমার খুব ঘুম পেত’।

 

এই হালিমা ১৯৬০-এর শেষের দিকে সিঙ্গাপুর চায়নিজ গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি তানজং ক্যানটং গার্লস স্কুলে এবং ১৯৭৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে এলএলবি অনার্স করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেসে (এনটিইউসি) একজন আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সেখানে ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন। কর্মদক্ষতার গুণে ১৯৯২ সালে হালিমা ইয়াকুব লিগ্যাল সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টরে উপনীত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজে ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। চাকরিরত অবস্থায় ২০০১ সালে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে এলএলএম ডিগ্রি নেন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৬ সালের ৭ জুলাই অনারারি ডক্টর অব ল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল হাবসিকে বিয়ে করেন। তাদের পাঁচটি সন্তান রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে ২০১১ সালে হালিমা সামাজিক উন্নয়ন, যুব ও খেলাধুলা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি দেশটির ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল মেয়াদে সংসদের নবম স্পিকার ছিলেন। এর আগে ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের মাঝে তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট হালিমা ইয়াকুব সংসদের স্পিকার ও সদস্য পদ ত্যাগ করেন। এরপর সিঙ্গাপুরের দলীয় সরকার পিপলস অ্যাকসন পার্টি (পিএপি) তাকে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়।

হালিমা রাজনীতিতে যুক্ত হন ২০০১ সালে। সেবারই প্রথম তিনি দেশটির জিআরসি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতা বিচারে মিনিস্টার অব স্টেট হন। গৌরবোজ্জ্বল ক্যারিয়ারে একে একে যুক্ত হতে থাকে আরও পদ ও পদবি। দেশটির ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থী হিসেবে পিএপি দলের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে বিবেচিত হন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ২০১৩ সালে ৮ জানুয়ারি সংসদের স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তখনো তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই দেশটির প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে নিজের নাম লেখাতে হয়েছে।

 

নারী জাগরণের এই যুগেও হালিমা ইয়াকুবের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এত এত সাফল্যের স্বাক্ষর থাকলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশটি একজন নারীকে কেন যেন মেনেই নিতে পারছিল না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে যখন সিঙ্গাপুরের নির্বাচন বিভাগ হালিমার নাম ঘোষণা করল তখন দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। স্পষ্টতই দেশটিতে জনমত ভাগ হয়ে গেল দুই ভাগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সরব থাকল ১১ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাদের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেল হালিমার বিপক্ষে ৮৩ শতাংশ এবং পক্ষে ১৭ শতাংশ অনুভূতি প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যোগ্যতা বিচারে তিনিই শেষ দৌড়ে টিকে থাকলেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

 

এই গুণী নারীর কাজের সফলতা হিসেবে অর্জনের ঝুলি বেশ ভারী। তিনি জীবনে অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। হালিমা ইয়াকুব ২০০১ সালে ম্যাক ডোনাল্ড অ্যাচিভার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, ২০০৩ সালে হার ওয়ার্ল্ড ওম্যান অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, ২০১১ সালে দ্য অ্যাওয়ার হিরোইন অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৪ সালে সিঙ্গাপুর কাউন্সিল অব ওমেন্স অর্গানাইজেন্স পুরস্কার লাভ করেন।

সর্বশেষ খবর