শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাহাড়ে বাংলার ছোঁয়া

মো. জহুরুল আলম, খাগড়াছড়ি

পাহাড়ে বাংলার ছোঁয়া

রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা হলেও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তার শিখন ও পঠনের বাস্তব চিত্র খুবই নাজুক। এখানে বসবাসরত একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তা ছাড়া কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর এই গোষ্ঠীর লেখাপড়ার প্রতিও রয়েছে বেশ অনীহা। ফলে দেখা যায় ভাষাগত ও শিক্ষাগত কারণে মূল ভূখণ্ডের বাঙালির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ে। দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় খাতে অবদান রাখা ও নানা ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও নিজেদের বঞ্চিত করেন। মুখ্য এসব বিষয়কে সামনে রেখে তাদের যাপিত জীবনের সার্বিক সুবিধা বজায় রাখতে প্রয়োজন পড়েছে রাষ্ট্রীয় ভাষা সঠিকভাবে শেখার। সে জন্য এগিয়ে এসেছে স্থানীয় জাবারাং কল্যাণ সমিতি, সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউএসএইড। তাদের অর্থায়নে রিড প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ের ৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই হাজার ৯০৫ জন শিক্ষার্থীকে মানসম্মত বাংলা পড়া, শুদ্ধভাবে উচ্চারণ, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে অনগ্রসর পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ে যেন এবার লাগল বাংলার ছোঁয়া।

২০১৫ সাল থেকে খাগড়াছড়ি জেলার ৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিড প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। ইউএসএইড এর অর্থায়নে এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-এর কারিগরি সহযোগিতায় জাবারাং কল্যাণ সমিতি পরিচালিত এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলায় পঠন দক্ষতা বৃদ্ধি করছে যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে দ্বিতীয় শ্রেণি পাস করার পরও বাংলা বর্ণমালা চেনে না, ‘কার’ চিহ্নের ব্যবহার বুঝতে পারে না, অধিকাংশ বর্ণের ধ্বনি ঠিকভাবে বুঝে না। এর প্রভাব হিসেবে তৃতীয় শ্রেণি এমনকি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়েও বাংলা সাবলীলভাবে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে না। লিখিত বিষয় যেমন প্রাথমিক গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্ম এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়ের বিষয়বস্তু ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারে না। যার ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে বা একই শ্রেণিতে বার বার থাকতে হয়। কোনোমতে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরোলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণি উপযোগী যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। ফলে নতুন প্রজন্মকে মানবসম্পদে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম হতে পারে কার্যকরী। এর অংশ হিসেবে বাংলা পাঠদান সংক্রান্ত বিষয়ে (ধ্বনি সচেতনতা, বর্ণজ্ঞান, শব্দভাণ্ডার, সাবলীল এবং বোধগম্যতা বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ প্রদান, প্রতি তিন মাস অন্তর শিক্ষার্থীদের পঠন দক্ষতা যাচাই করা হচ্ছে। দুর্বল শিক্ষার্থীদের বিশেষ সহায়তা প্রদান, কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের মাধ্যমে স্কুল আওয়ারের পর চালানো হচ্ছে পড়ার কার্যক্রম। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াছমিন জানান, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে জাবারাং বাংলা পড়ার ওপর যে কাজ শুরু করেছে তা খুবই ভালো উদ্যোগ’। তিনি এর মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়াসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন বয়ে আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জাবারাং-এর নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, ‘এই কার্যক্রমের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা শৈশবকাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে বাংলাসহ অন্যান্য বিষয়ে ঠেকবে না’।

দুর্গম পাহাড়ে খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১৯ কি.মি দূরে ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নের বড়পাড়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠ্যবই ছাড়াও বিভিন্ন হাসি-রসের মজার মজার গল্প করা ও পড়ানো হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ম্যানেজার সুব্রত চাকমা জানান, আমরা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি, দীঘিনালা ও সদর উপজেলার দুর্গম এলাকার ৪৫টি স্কুলের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা শুদ্ধভাবে পড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খগেশ্বর ত্রিপুরা, রিড প্রকল্পের শিক্ষক কালা চান ত্রিপুরা জানান, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ এলাকায় শিশুরা বাংলা ভাষায় পড়তে, লিখতে ও বোঝার ব্যাপারে খুবই দুর্বল। আমাদের ধারণা এই কার্যক্রম ভিন্নভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর