শিরোনাম
শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
প্রচ্ছদ

পাটের বিকল্প আর কে ফাইবার

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

মর্তুজা নুর, রাবি

পাটের বিকল্প আর কে ফাইবার

হৃৎপিণ্ডকে গ্রাস করতে চেপে ধরেছিল হৃদরোগ। দীর্ঘদিন চিকিৎসক-রোগী আর রোগের ত্রিমুখী যুদ্ধে হেরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হয় মরণব্যাধি হৃদরোগকে। রোগ সেরে গেলেও মনে তৈরি করে যায় গভীর দাগ আর মাথায় নতুন ভাবনার খোরাক। এরপর তিন বছর সকাল গড়িয়ে রাত হলেও নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে তিনি লেগে যান হৃদরোগ প্রতিরোধের ওষুধ তৈরিতে। এমন একটা ওষুধ যা মানুষের হৃৎপিণ্ডে জমে থাকা চর্বিকে দ্রবীভূত করে কমাবে হৃদরোগের প্রকোপ।

কিন্তু দিন গড়ালেও পরিকল্পনা আলোর মুখ না দেখায় কিছুটা দমে যান তিনি। ঠিক তখনই হাতে লাগে নতুন এক মাইক্রো অর্গানিজম। যা গাছপালার ডাল থেকে আঁশ আলাদা করতে সক্ষম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই মাইক্রো অর্গানিজম থেকে দাঁড়িয়ে যায় পাটের চেয়ে উজ্জ্বল আর নরম ফাইবার। তার বাবা-মায়ের নামে সন্তানতুল্য এই উদ্ভাবনের ব্র্যান্ড নাম দেন ‘আর কে ফাইবার’। এ গল্প পাটের আঁশের বিকল্প আবিষ্কারক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামের। সোনালি আঁশের সাফল্যের গল্পগাথা আড়ালের কাহিনী আরও চমকপ্রদ। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মাইক্রো অর্গানিজম আবিষ্কারের পর গত জানুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের কাজলা বাজার থেকে খাসির কিছু চামড়া কিনে এনে আমার চেম্বারে রাখি। চেম্বারে ওই চামড়াগুলো মাইক্রো অর্গানিজমে রেখে দিই। ২০ দিন পর দেখি চামড়া থেকে লোম বাদে সব কিছু আলাদা হয়ে গেছে। তখনই মাথায় আসে পাটের বিকল্প আঁশ তৈরির চিন্তা।

কয়েক দিন পর আমার বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড় থেকে বেড়ে ওঠা গাছ-গাছালি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি। এবারও দেখি যে একইভাবে গাছগুলো থেকেও ফাইবার ছাড়া সব অংশ আলাদা হয়ে গেছে। সুপারি, কলাসহ কয়েক রকমের গাছ নিয়ে এ ধরনের গবেষণা চালাতে থাকি। তবে এই গাছগুলো থেকে পাওয়া আঁশগুলো পাটের আঁশের চেয়ে কোনোটা বেশি শক্ত আবার কোনোটা বেশি নরম। তখন ভাবলাম এই নরম আঁশগুলো দিয়ে লেপ-তোশক আর শক্ত আঁশগুলো দিয়ে ঝাড়ু তৈরি করা সম্ভব। জঙ্গলে খুঁজতে খুঁজতে হাতে পেলাম এক ধরনের গাছ, যার আঁশ খুবই আরামদায়ক, শক্ত ও স্থায়িত্বশীল। এই আঁশ পাট থেকে পাওয়া আঁশের চেয়েও কিছুটা উজ্জ্বল। যা দিয়ে তৈরি পোশাকও হবে অনেক বেশি উজ্জ্বল। গবেষণার স্বার্থে এই মুহূর্তে গাছটির নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

তবে বর্তমানে গবেষণা কার্যক্রম চলছে খুবই ধীরগতিতে। এর মধ্যেই গবেষণায় পাটের বিকল্প আবিষ্কার ও রঙের কাজ করা হয়েছে। আরও অনেক কিছু বাকি। আর গবেষণা কাজ নিজ খরচের কারণে একটু ধীরে কাজ এগোচ্ছে। যদি কেউ সহযোগিতা করে তখন দেখা যাবে। আমি বিশ্বাস করি, যদি এটি পুরোপুরি সফলতার মুখ দেখে তবে পাট উৎপাদনের চেয়ে অনেক কম খরচে এই আঁশ উৎপাদন করা যাবে। যা ব্যাপকভাবে টেক্সটাইল ও রেডিমেট গার্মেন্ট শিল্পে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পাটের বিকল্প প্রাকৃতিক এই আঁশ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি, এই দাবি করা বোধ হয় অনুচিত হবে। সত্যি কথা বলতে, এই আবিষ্কারটা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া আমার একটা গবেষণা কাজের বাই প্রোডাক্ট। আমি বেশ কিছু বছর ধরে রহস্যময় কিছু মাইক্রো অর্গানিজম নিয়ে গবেষণা করছি। বিশেষ ধরনের এই মাইক্রো অর্গানিজম থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী এনজাইম নিঃসৃত হয়। যার অন্যতম বিশেষ ক্ষমতা হলো, মৃত গরু-ছাগলের চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকা চর্বিকে কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত করে ফেলতে পারে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান গবেষণার এই ফলাফল আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, উন্নতমানের কোনো ল্যাবরেটরিতে আমার এই মাইক্রো অর্গানিজম থেকে নির্গত নির্যাসের পিউরিফিকেশন নিয়ে কাজ করতে পারলে নতুন ধরনের ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হতো। এই ওষুধ মানবদেহের রক্তনালির ভিতরে অস্বাভাবিকভাবে জমাট বাঁধা চর্বিকে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া নিরাপদভাবে গলিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। আর সেটা করা সম্ভব হলে হৃদরোগ এবং ব্রেন স্ট্রোকের মতো জীবনধ্বংসী রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে।

 

আসলে রহস্যময় আমার এই মাইক্রো অর্গানিজম থেকে নিঃসৃত মেটাবোলাইটসই সবকিছুর মূল হোতা। এটা ব্যবহার করেই আমি সবুজ গাছের লিপিড বা ফ্যাট গলিয়ে ফেলে উজ্জ্বল, রেশমী এই প্রাকৃতিক আঁশ তৈরি করেছি। যার নাম আমি দিয়েছি ‘আর কে ফাইবার’। হয়তোবা, আমার উদ্ভাবিত এই মাইক্রো অর্গানিজম থেকে নিঃসৃত মেটাবোলাইটস ব্যবহার করে মূল পাটকে আরও উজ্জ্বল ও অধিক শক্তিশালী পাটের আঁশ পাওয়া সম্ভব। গবেষণার পরবর্তী ধাপে এই কাজটির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেবেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, যদি এই ফাইবারের ওপর আমি একাডেমিক গবেষণা সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে এটি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। এই বিজ্ঞানীর মতে, গবেষণা কখনো শেষ হয় না। হাতের নাগালে আমরা যা-ই পাই, তাই নিয়ে গবেষণা করা উচিত। তার গবেষণা কাজটির শেষ নামাতে ভালো পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সেটা হতে পারে পৃথকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, একাডেমিক বা সরকারিভাবে।

অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম রাবির বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। তিনি বাংলাদেশ ফার্মাসি কাউন্সিলের সদস্য এবং ফার্মাসিউটিক্যাল জার্নালের চিফ অব ইকোনমিক ডিরেক্টর। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সারবিরোধী গবেষণার সঙ্গেও জড়িত তিনি।

সর্বশেষ খবর