শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সারা বাংলা

বাদশার সাইকেলে নীরব বিপ্লব

বাদশার সাইকেলে নীরব বিপ্লব

ভালো কাজের জন্য খুব বেশি কিছু দরকার পড়ে না। একটুখানি সদিচ্ছা আর উদ্যম থাকলেই নীরবে চালিয়ে যাওয়া যায় যে কোনো ধরনের ভালো কাজ। আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এরকমই একজন সাদামাটা মানুষ পাবনার বেড়ার বাসিন্দা বাদশা আলম। নিজের জরাজীর্ণ সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণ করেন তিনি। পরিত্যক্ত বা পতিত জমি রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের কাছে বিনামূল্যে বীজ তুলে দেওয়ার পর সেটি বপন এবং পরিচর্যার পথও বাতলে দেন বাদশা। এভাবেই অসংখ্য পরিবারে সবুজের আলো জ্বেলেছেন তিনি।

 

বিনাস্বার্থে নিজের গাঁটের পয়সা আর সময় খরচ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাক-সবজির বীজ বিতরণ করে বেড়ান একজন। তিনি কোনো এনজিওর ফান্ড কিংবা সরকারি তহবিলের সহায়তায় এসব করেন না। তিনি পুরোটাই করছেন নিজের ইচ্ছায়। শুধু তাই নয়, বাল্যবিবাহ, যৌতুকের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েও কথা বলেন। মানুষকে সচেতন করে তোলেন এসবের বিরুদ্ধে। তার নাম বাদশা আলম। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী বাদশা পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের সন্তান। বাবা আবদুল বাতেন মোল্লা ও মা মনোয়ারা খাতুনের চতুর্থ এই সন্তানের নাম এখন পাল্টে গেছে। সবাই এখন তাকে ডাকে ‘সাইকেল বাদশা’। তাঁত সমৃদ্ধ গ্রাম জগন্নাথপুরের এই তাঁতশ্রমিক সাইকেল নিয়ে ১০ বছর ধরে মানুষের বাড়ি বাড়ি বিনামূল্যে বিতরণ করছেন শাক-সবজির বীজ। শুধু সবজির বীজই নয়, সমাজসচেতনতামূলক বিভিন্ন লিফলেটও বিতরণ করেন তিনি।

 

সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার তাঁত বন্ধ থাকে। সপ্তাহের এই দিনটিতেই বাদশা তার ভাঙা সাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সাইকেলের সামনে ও পেছনে মানুষকে সচেতন করার জন্য লেখা থাকে বিভিন্ন স্লোগান। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ও তার নিজের গলায় ঝোলানো থাকে বিভিন্ন সবজির বীজে ভর্তি বোতল। ঘুরে বেড়ান গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। চলার পথে কোনো বাড়ির পাশে পতিত জমি দেখলেই মালিককে ডেকে তাদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সঙ্গে রাখা বিভিন্ন সবজির বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করেন। বিতরণকালে বীজ বপন ও যত্ন করার পদ্ধতিও বলে দেন। কখনো কখনো তাতে নিজেও হাত লাগান। আবার বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও মাদকবিরোধী লিফলেট ছাপিয়েও বিতরণ করে মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস চালান বাদশা আলম।

 

বাদশা পড়াশোনা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। তাঁতশ্রমিকের কাজ করে প্রতিদিন আয় করেন ২০০-২৫০ টাকা। তার স্ত্রী মিনারা খাতুনও সংসারের কাজের ফাঁকে তাঁতের কাজ করেন। তাদের দুজনের আয়ে চলে সংসার। বাদশা জানান, ‘প্রতি মঙ্গলবার তাঁত বন্ধ থাকে। ওই দিন তিনি স্লোগানসংবলিত সাইকেল আর বীজ নিয়ে বের হন। সপ্তাহের অন্য কোনো দিন তাঁত বন্ধ থাকলে সেদিনও বের হন।’

বাদশার এমন অভ্যাস কিন্তু ছোটবেলা থেকেই। তখন থেকেই বাদশা অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলেন। গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যেতেন সবার আগে। কাউকে হাসপাতালে নেওয়া, ওষুধ আনা কিংবা ছোট-বড় যে কাজই হোক বিপদে আক্রান্ত মানুষের পাশে থাকতেন বাদশা। গ্রামবাসীও তাকে দেখে স্নেহের চোখে। ধীরে ধীরে বাদশা হয়ে উঠেন সবার প্রিয়পাত্র।

 

বাদশা আলম জানান, ‘ছোটবেলায় দেখতাম, মা বাড়ির পাশে ফেলে রাখা জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি লাগাতেন। সবজির বীজ হলে সেগুলো যত্ন করে রাখতেন এবং পাড়া-প্রতিবেশী বাড়িতে এলে তাদের বীজ দিতেন। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, মা তুমি বীজ অন্য মানুষকে দাও কেন? মা বলতেন, প্রতিবেশীদের বীজ দেওয়া ভালো। এতে আল্লাহ খুশি হন। প্রতিবেশীদের প্রতি মায়ের এই ভালোবাসা আমাকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি মায়ের সেই কাজটি এখন নিজে করি। গ্রামের মানুষকে বিনামূল্যে শাক-সবজির বীজ বিতরণ করি।’

 

নিজের ভালো কাজ নিয়ে খুব বেশি আহ্লাদিত নন বাদশা। বললেন, ‘আমি মনে করি, একটি ভালো কাজ কোনো দিনও হারিয়ে যায় না। করলে একটি করে ভালো কাজ, বদলে যাবে এ দেশের সাজ। তাই সবারই উচিত কোনো না কোনো ভালো কাজে সম্পৃক্ত থাকা।’

 

এর বাইরে বাদশা সমাজসচেতনতামূলক নানা স্লোগান লিখে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে সেঁটে দেন। ধীরে ধীরে এ কার্যক্রম বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে পেশাদার শিল্পী দিয়ে টিনের ওপর সাইনবোর্ড আকারে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদকবিরোধীসহ সচেতনতামূলক নানা স্লোগান লিখিয়ে গ্রামের বাইরেও সাঁটাতে শুরু করেন বাদশা। সাত-আট বছর আগে ভাঙাচোরা সাইকেল কিনে তাতেই শুরু করেন মানুষকে সচেতন করার প্রচারণা। আর সেই প্রচারণার সঙ্গে সবজির বীজ বিতরণের কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে।

 

অবসর সময়ে বাদশা গ্রামের কৃষকদের সবজি চাষে সহায়তা করেন। কৃষকরাও জানেন বাদশার বিনামূল্যে বীজ বিতরণের কথা। তারা বীজ উৎপাদনের সময় বাদশার জন্যও বেশি করে উৎপাদন করেন। সেই বীজ আবার পৌঁছে যায় গ্রামময়। এভাবেই সাইকেল বাদশা নীরবে চালিয়ে যাচ্ছেন তার সংস্কার বিপ্লব।

সর্বশেষ খবর