শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

লাল পাথরের মিনার

লাল পাথরের মিনার

দিল্লির কুতুব মিনারটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। কুতুবউদ্দিন আইবেক এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। লাল বেলেপাথরে নির্মিত ২৩৮ ফুট উচ্চতার এ মিনার এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ পাথর নির্মিত মিনার বা স্তম্ভ বলে স্বীকৃত। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে এটি। ঘুরে এসে লিখেছেন— গাজী মুনছুর আজিজ

 

লাল বেলেপাথরের কুতুব মিনারটি দেখে সত্যিই অবাক হই। কেবল পাথর দিয়েই ২৩৮ ফুট উচ্চতার এ স্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৮০০ বছর আগে। আর এখন পর্যন্ত এটিই পাথর নির্মিত বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার বা স্তম্ভ বলে স্বীকৃত। এ মিনারের পাদদেশেই দিল্লি সফরের এক দুপরে হাজির হই। সঙ্গে আছেন সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ। মিনারের আশপাশে আছে আরও অনেক প্রাচীন স্থাপনা। সব মিলিয়ে কুতুব কমপ্লেক্স। ইনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে এ কমপ্লেক্স।

টিকিট কেটে কমপ্লেক্সে ঢুকতেই আছে বড় একটি গেট। এ গেটের নাম আলাই দরজা। ছোট-বড় পাথরের মিশেলে ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এ গেট অনেকটা মসজিদের গেটের মতো। ধারণা করা হয় এ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করার জন্য এই গেটই প্রধান দরজা হিসেবে ব্যবহূত হতো, সে জন্য এর নাম আলাই দরজা। আলাই দরজা পার হয়ে সামনে এগোই আমরা। প্রথমেই আসি কুতুব মিনারের পাদদেশে। ইতিহাস থেকে জানি, কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে এ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময় ইলতুতমিশের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তারপর বেশ কয়েক বছর পর আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) মিনারের প্রাঙ্গণের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হয়। নির্মাণের অনেক বছর পর বজ্রপাতে মিনারের কিছুটা ক্ষতি হয়, তবে পরবর্তীতে তা সংস্কারও করা হয়।

কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন মধ্যযুগীয় ভারতের একজন তুর্কি শাসক। দিল্লির প্রথম সুলতান ও গোলাম বা মামলুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। সুলতান হিসেবে তিনি ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। অবশ্য তার জন্ম কোথায় তা জানা যায়নি। ধারণা করা হয় মধ্য এশিয়ার কোনো এক স্থানে তার জন্ম। তার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন তুর্কি। শিশু বয়সেই তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় ইরানের খোরাসান অঞ্চলের নিসাপুরের প্রধান কাজী সাহেবের কাছে। কাজী মারা গেলে কাজীর ছেলে কুতুবউদ্দিন আইবেককে আবারও বিক্র করেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরির কাছে।

নিচ থেকে মিনারের ওপরের দিকে তাকিয়ে সত্যিই বিস্মিত হই। বেলেপাথরের এ উঁচু মিনারটি কেবল মিনারই নয়, নান্দনিক কারুকার্যের স্তম্ভও বটে। মিনারটির নিচের অংশের ব্যাস ৪৭ ফুট। আর একেবারে ওপরের অংশের ব্যাস ৯ ফুট। গোলাকার এ মিনারের চারপাশে লাল বেলেপাথরে খোদাই করা আরবি ক্যালিগ্রাফি বা কোরআনের আয়াত লেখা। আবার এ ক্যালিগ্রাফির ওপর ও নিচে আছে বেলেপাথরেরই খোদাই করা বিভিন্ন নকশা। এসব নকশার মধ্যে আছে ফুল, পাতা ও বিভিন্ন জ্যামিতিক অবয়ব। দূর থেকে দেখলে এ নকশাগুলোকে ক্যালিগ্রাফির ফ্রেমের মতোই দেখায়। মিনারের নিচ থেকে কিছুটা পর পরই মিনারের চারপাশে এ ক্যালিগ্রাফি ও নকশা।

ক্যালিগ্রাফি ও নকশা ছাড়াও মিনারের চারটি স্তরে বারান্দা বা বেলকুনির মতো জায়গা আছে। সেই সঙ্গে আছে জানালা। আর মিনারের ভিতর দিয়ে ওপরে উঠার সিঁড়িও আছে। তবে এ সিঁড়ি দর্শনার্থীরা ব্যবহার করতে পারেন না। অবশ্য মিনারের পাদদেশের চারপাশে স্টিলের রেলিং দেওয়া আছে, যাতে দর্শনার্থীরা মিনারের দেয়াল ধরতে না পারেন।

বিস্ময়ের কুতুব মিনার থেকে আসি কুব্বত-উল-ইসলাম মসজিদ প্রাঙ্গণে। মূলত এটি মসজিদের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ। ধ্বংসপ্রাপ্তের পরও মসজিদটির মূল গেটের অনেকটা এখনো অক্ষত। এ গেটের দেয়ালজুড়েই আছে পাথরের খোদাই করা আরবি ক্যালিগ্রাফি ও নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা। রাজপুতদের ওপর বিজয়ের স্মারক হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন।

মসজিদটির মূল গেটের সামনে খোলা প্রাঙ্গণ। আর পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে আছে একতলা সমপরিমাণ স্থাপনা। পাথরে খোদাই করা নকশি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ স্থাপনা। এর ছাদও দেওয়া হয়েছে বড় বড় পাথর কেটে। প্রতিটি খুঁটির চারপাশেই আছে নকশি কারুকাজ। সত্যি বিস্ময় জাগে এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নান্দনিক নকশার এসব খুঁটির স্থাপনা দেখে।

মসজিদের গেটের সামনে লোহার একটি স্তম্ভ দেখি। এটিকে দিল্লির লৌহ স্তম্ভ বলে। এর উচ্চতা ২৩.৭ ফুট। এ স্তম্ভেরও রয়েছে ইতিহাস। কথিত সে ইতিহাস থেকে জানি, ৪০২ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদয়গিরিতে এ স্তম্ভ প্রথম স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে এটি বর্তমান স্থানে আনা হয়। স্তম্ভটির নিচের অংশের ব্যাস ১৭ ইঞ্চি ও ওপরের অংশের ব্যাস ১২ ইঞ্চি। স্তম্ভটির গায়ে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা আছে এর ইতিহাস। এছাড়া মসজিদের খোলা প্রাঙ্গণে তিনটি সমাধিও আছে।

মসজিদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে এবার আসি কুতুব কমপ্লেক্সের আরেক বিস্ময় আলাউদ্দিন খিলজির মাদ্রাসা ভবনে। অনেক কক্ষ নিয়ে এ মাদ্রাসা ভবন। অবশ্য এ ভবনও ধ্বংসপ্রাপ্ত। নানা আকৃতির ছোট-বড় পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ মাদ্রাসা ভবন। এটা দেখে আবারও বিস্মিত হই সে সময়কার মানুষের নির্মাণ দক্ষতার কথা ভেবে। মাদ্রাসা ভবনের পাশে আছে আলাউদ্দিন খিলজির সমাধি। এর পাশেই আছে ইলতুতমিশের সমাধি ভবন। এ সমাধি ভবনের দেয়াল ও দরজায়ও আছে পাথরে খোদাই করা আরবি ক্যালিগ্রাফি ও নান্দনিক নকশার কারুকাজ।

খিলজির সমাধির পাশে আরও আছে আলাই মিনারের অসমাপ্ত স্তূপ। এ মিনারটির কিছুটা নির্মাণ হলেও পরে আর তা সমাপ্ত হয়নি। অসমাপ্ত এ মিনারের পাশে অব্যবহূত একটি কূপও আছে। এছাড়াও কমপ্লেক্সের ভিতর দেখি আরও কয়েকটি সমাধি।

 

যেভাবে যাবেন

বাস, ট্রেন বা বিমানে কলকাতা। শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস বা দূরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে যাওয়া যাবে দিল্লি। চাইলে কলকাতা থেকে বিমানেও দিল্লি যেতে পারবেন। দিল্লি শহরের যে কোনো স্থান থেকেই ট্যাক্সিতে যেতে পারবেন কুতুব মিনার। এছাড়া দিল্লি শহরের অনেক স্থানে মেট্রোরেলের যাতায়াত আছে। চাইলে মেট্রোরেলে কুতুব মিনার স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে কুতুব মিনার যাওয়া যাবে।

 

যেখানে থাকবেন

দিল্লি শহরজুড়েই আছে পাঁচ তারকাসহ নানা মানের হোটেল। অনেক বেশি হোটেল পাবেন পাহাড়গঞ্জ এলাকায়। এটা দিল্লির পুরনো শহর বা বাজার। এখানে নানা মানের হোটেল আছে। ভাড়া ৬০০ রুপি থেকে শুরু করে ৬ হাজার রুপি পর্যন্ত। মোটামুটি মানের হোটেল ৬০০ বা ৮০০ বা ১ হাজার রুপিতে পাবেন এবং দুইজন থাকতে পারবেন ভালোভাবে।

 

খাওয়া-দাওয়া

পাহাড়গঞ্জ এলাকায় ছোট-বড় নানা মানের রেস্টুরেন্ট আছে। সাদাভাত, বিরিয়ানি, মাছ, মাংস, শাক-সবজি সবই পাবেন। ১৫০ থেকে ২০০ রুপিতে থালি প্যাকেজ পাবেন। এক থালিতে ভাত, ডাল, সবজি, সালাদ থাকে। ২০০ বা ২৫০ রুপির মধ্যে মাছ-মাংসও পাবেন।

 

কেনাকাটা

ভারতের রাজধানী শহর দিল্লি। তাই শহরজুড়েই আছে ছোট-বড় অসংখ্য শপিং মল। আর এসব শপিং মলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলো পাবেন। বিশেষ করে পাবেন দার্জিলিংয়ের চা, কাশ্মীরের রেশমি কাপড়, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ বা বিভিন্ন রাজ্যের তাঁতের কাপড়। আর পাবেন নানা স্বাদের চকোলেট। এক দামের দোকান ছাড়া দরাদরি কেরে কেনার সুযোগও আছে। তবে যেখানে এক দাম সেখানে দরাদরি করতে যাবেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর