শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সারা বাংলা

প্রতিবন্ধীদের স্কুল পড়াচ্ছেন শিখাচ্ছেন মোর্শেদা আপা

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

প্রতিবন্ধীদের স্কুল পড়াচ্ছেন শিখাচ্ছেন মোর্শেদা আপা

কারও হাত বাঁকা, কারও পা, কেউ ঠিক করে কথা বলতে পারে না, কেউ হাঁটতে পারে না, কেউ বা আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসে। এসবের পরও আরও কয়েকজন আছে যারা মা-বাবার কোলে করে বৈকালিক স্কুলে আসে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। শারীরিক অঙ্গের আঙ্গিকতা না থাকলেও তাদের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি আছে অদম্য। অদম্য এই প্রতিবন্ধীরা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দরিদ্রতার কশাঘাত তাদের এই অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর তাদের আলোকিত পথের যাত্রী করে তুলছেন আরেক অদম্য নারী  মোর্শেদা আপা (মোর্শেদা হক)।

বগুড়ার ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ি গ্রামের মোর্শেদা হককে সবাই মোর্শেদা আপা বলে ডাকেন। মোর্শেদা হকের চেয়ে মোর্শেদা আপা বললে এই গ্রামের মানুষ তাকে দ্রুত চিনতে পারে। মোর্শেদা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন স্বাস্থ্য নিয়ে। অথচ মোর্শেদা হকের জন্ম গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জের শ্রীপতিপুর গ্রামে। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মোজাম্মেল হক। মোর্শেদা হক চাকরির সূত্রে থাকেন ধুনট উপজেলা সদরের প্রফেসরপাড়ার ভাড়া বাড়িতে। তিনি প্যারামেডিকেল কোর্সে অধ্যয়নরত। নিজের দায়িত্ব পালনকালে চৌকিবাড়ি এলাকায় তিনি দেখতে পান ৪০ জনেরও বেশি প্রতিবন্ধী। তারা একদিকে যেমন দরিদ্র তেমন সাক্ষরতা জ্ঞানও নেই তাদের। দিন যাচ্ছে বড় হচ্ছে আর দরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী মানুষগুলো বোঝা হয়ে ভার বাড়াচ্ছে। তাদের নিয়ে কিছু করার চিন্তা করেন মোর্শেদা হক। চিন্তায়-চেতনায় তিনি তাদের শিক্ষাদান করতে উঠেপড়ে লাগেন। গ্রামের কিছু তরুণ ও বয়স্ককে একত্র করে তিনি প্রথমে গড়ে তোলেন ‘উজ্জীবিত প্রতিবন্ধী উন্নয়ন’ নামের একটি ক্লাব। এই ক্লাবের লোকজনের সহযোগিতা নিয়ে ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ি গ্রামে দরিদ্রের কশাঘাতে জর্জরিত সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধীদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ বৈকালী পাঠশালা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন বেসরকারি উন্নয়নকর্মী মোর্শেদা হক। নিজের দায়িত্ব পালন শেষে বিকালে প্রতিবন্ধী শিশু ও বয়স্কদের শিক্ষাদান শুরু করেন। বিকালে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে স্কুল ঘরটির নাম দেওয়া হয় বৈকালী পাঠশালা। প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি প্রতিবন্ধীদের স্বাক্ষর জ্ঞানদানের পাশাপাশি একাডেমিক পাঠদান করে যাচ্ছেন। পাঠশালায় স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর জ্ঞান শেখানোসহ প্রতিবন্ধীদের পরিবেশ, পুষ্টি, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান করা হয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের জন্য যেন বোঝা হয়ে না দাঁড়ায় সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন মোর্শেদা হক। মোর্শেদার বৈকালী পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকেই এখন স্বাক্ষর জ্ঞান, পড়তে পারে এবং লিখতে পারে। এমন আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী আছেন যারা লেখাপড়া বাদ দেওয়ার পর মোর্শেদার পাঠশালায় এসে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে আবারও স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন।

মোর্শেদা হকের বৈকালী পাঠশালার ঘরটি টিনের বেড়া ও ছাউনি বিশিষ্ট। চৌকিবাড়ি গ্রামের জনৈক ব্যক্তি ঘরটির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেই ঘরের মেঝেতে চলে প্রতিবন্ধীদের পাঠদান কার্যক্রম। সপ্তাহের শনি, সোম ও বুধবার বিকালে প্রতিবন্ধীরা তাদের প্রিয় পাঠশালায় চলে আসেন। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে ৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন। যারা প্রত্যেকেই অক্ষর জ্ঞান অর্জন করছেন।

বৈকালী পাঠশালার শিক্ষার্থী মো. রাব্বী জানায়, সে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর প্রতিবন্ধিতাসহ নানা কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়নি। পরে মোর্শেদা আপার পাঠশালায় গিয়ে আবারও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। সে বছরই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি এবং পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর এখন সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। শিক্ষার পাশাপাশি সে মোবাইল হার্ডওয়্যারের কোর্স করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে।

বৈকালী পাঠশালার শিক্ষার্থী আপন, তানিয়া, জাকির হোসেন জানায়, মোর্শেদা আপার চেষ্টায় তারা বর্ণমালা চিনতে পারে, লিখতে পারে। আগে তারা বর্ণমালা না চিনলেও এখন পারে।

তানিয়ার মা হাওয়া বেগম জানান, তার মেয়ে এখানে এসে অনেক কিছু শিখেছে। ইশারায় এখন সে বেশ ভালোভাবে কথাও বলতে পারে এবং বোঝেও। তার পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, ‘আমার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। কোলে করে পায়ে হেঁটে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসি। প্রতিদিন কষ্ট করছি। মনেপ্রাণে চাইছি মেয়েটা একটু পড়তে ও লিখতে পাড়ুক। সে কিছু কিছু বর্ণমালা লিখতে পারে। নিজের নামও লিখতে পারে। এর আগে কেউ আমার মেয়েকে শিক্ষার বিষয়ে বলেনি।’

স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিরা জানান, প্রতিবন্ধীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে স্কুলটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তবে সেটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। নেই নিজস্ব কোনো ভবন। নেই শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। যথেষ্ট অভাবের মধ্য দিয়েও চলছে স্কুলটি। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে, এটাও একটা মেয়ে কাজটা করে যাচ্ছে।

বৈকালী পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা মোর্শেদা হক জানান, প্রতিবন্ধীদের জন্য ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই পাঠশালা করা। এখান থেকে তারা যেন অক্ষর জ্ঞানসহ নৈতিক শিক্ষা নিতে পারে। তারা যেন আলোর পথের যাত্রী হয়ে সমাজের জন্য বোঝা হয়ে না থাকে। সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ কিছ বয়স্ক ও শিশু প্রতিবন্ধী এখন পড়তে পারে। তারা পত্রিকাও পড়তে পারে। সবাই প্রতিবন্ধী হলেও তাদের দেখাদেখি কিছু সুস্থ মানুষও আসছে অক্ষর জ্ঞান আহরণে। বর্তমানে ৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৩৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। যারা সবাই একই গ্রামের বাসিন্দা।

সর্বশেষ খবর