শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
অনুপ্রেরণীয়

তাদের হাতে ৯ উপজেলা

নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল

তাদের হাতে ৯ উপজেলা

টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে বর্তমানে ৯টিতে নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ৯ জন নারী। দক্ষ পুরুষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এই নারী কর্মকর্তারা। প্রশাসনের বিভিন্ন পদ-পদবিতে তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। দেশ পরিচালনায় প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে নানা উদাহরণ সৃষ্টি করছেন এই নারী কর্মকর্তারা। উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা নারী ইউএনওরা সফলতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে— উপজেলায় অবস্থিত সব বিভাগের কাজকর্মের সমন্বয় সাধন করা। মাদকমুক্ত, যৌতুক-বাল্যবিয়ে রোধ ও জঙ্গিমুক্ত সামাজিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার তাদের ওপর ন্যস্ত। এ ছাড়া একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি উপজেলার সব দায়িত্ব তদারকি করে থাকেন। পাশাপাশি জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন এই নারী ইউএনওরা। উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের রয়েছে সাধারণ, রাজস্ব, ফৌজদারি ও উন্নয়ন প্রশাসন বিষয়ে দায়িত্ব পালনের ভার। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তদারকি করা, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ তদারকি ও বাস্তবায়ন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি ও পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন তারা। এ ছাড়াও এসিল্যান্ড ও পুলিশের বিভিন্ন পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

জিনাত জাহান, টাঙ্গাইল সদর

জিনাত জাহান। প্রশাসনের ২৭তম বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ তিনি। পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলা সদরের অ্যাডভোকেট কাজী মো. কুদ্দুসের মেয়ে জিনাত। স্বামী আসাদুজ্জামান মিয়া পুলিশ কর্মকর্তা। ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন উপজেলা প্রশাসনকে মানুষের সেবামুখী করে তোলার। সেবা নিতে এসে মানুষকে যেন বঞ্চিত হতে না হয়— এ জন্য তার অফিসকে সাজিয়েছেন ডিজিটাল করে। তিনি প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করার পাশাপাশি বাল্যবিয়ে বন্ধ, মাদক নির্মূল করতে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন। এরই মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে আলোচনায় এসেছেন। তবে এসব কাজের ক্ষেত্রে মাঝে-মধ্যে বাধার সম্মুখীন হলেও নিজস্ব মনোবল ও জনসাধারণের সহযোগিতায় সব বাধা কাটিয়ে অর্জন করেছেন মানুষের মন।

 

ইসরাত সাদমীন, মির্জাপুর

এই উপজেলা ইসরাত সাদমীনের দখলে। প্রশাসনের ২৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ইসরাত। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা সদরের মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল হুদার কন্যা। মা একজন সরকারি কর্মকর্তা। ইসরাত ইউএনও হওয়ার পর পুরো উপজেলায় শিক্ষার হার অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের অভিশাপ কাটিয়ে কিশোরীরা যাচ্ছে স্কুলে। শুধু পাস নয়, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ইউএনও ইসরাতের পরামর্শে উপজেলা শিক্ষা অফিস সমাপনী পরীক্ষার্থীদের ডাটাবেজ তৈরি করে। সুযোগ মতো ইউএনও ইসরাত সাদমীন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ফোন দিয়ে কথা বলে তাদের সন্তানের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর নেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় তিনি টাঙ্গাইল জেলার শ্রেষ্ঠ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছেন।

 

আসমা শাহীন, নাগরপুর

এই উপজেলা প্রশাসনের ২৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা শাহীন। বাংলাদেশ বিমানের সাবেক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবিএম সালেহর মেয়ে। স্বামী একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর একটাই চ্যালেঞ্জ, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা যাতে একধাপ এগিয়ে যেতে পারে। তার কাছে রাত-দিন একসমান। বাল্যবিয়ে বন্ধ বা মাদক নির্মূলে রাত ২-৩টার সময় গিয়েও হাজির হন ঘটনাস্থলে। বন্ধ করেন বাল্যবিয়ে। এসব করতে গিয়ে সমাজের কিছু লোকের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হলেও পরবর্তীতের আলোচনার মাধ্যমে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি উপজেলার শিক্ষা ক্ষেত্রে নকলমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। অপরাধে জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তিও দেন। সবার সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষায় উৎসাহী করে তোলার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শও করেন তিনি।

 

শামসুন নাহার স্বপ্না, বাসাইল

শামসুন নাহার স্বপ্না। প্রশাসনের ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অন্য সবার মতো শিক্ষার উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং মাদক নির্মূলই তার ভাবনা। তিন লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য শিক্ষার হার বৃদ্ধি। কেননা, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ফলে সমাজ থেকে সব দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। সুযোগ পেলেই ছুটে যান বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। স্বপ্নার বাবা জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা।

 

মৌসুমী সরকার রাখী, সখীপুর

সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী সরকার রাখী। তিনিও প্রশাসনের ২৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ। বাড়ি পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলা সদরে। পিতা একজন স্কুলশিক্ষক এবং মা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। স্বামী একজন প্রকৌশলী। সখীপুর ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। যোগদানের পর থেকে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। চেষ্টা করেন মানুষের সমস্যা সমাধান করার। পাহাড়ি এলাকা সখীপুরে রয়েছে বেশ কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করছেন তিনি। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো উৎসাহী ছেলে-মেয়েদের জন্য স্কুলের টিফিন ও প্রাথমিক শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ।

 

আরিফা সিদ্দিকা, ধনবাড়ী

আরিফা সিদ্দিকা। ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ইউএনও। তিনি যোগদানের পর থেকেই বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং ইভ টিজিং বন্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। আর এসব কাজে পাশে পাচ্ছেন গ্রামের সাধারণ মানুষকেও। পাশাপাশি শিক্ষায়ও দিয়েছেন বিশেষ গুরুত্ব। ইউএনও আরিফার বাবা শামছুল আলম ভুইয়া। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

 

দিলরুবা শারমিন, গোপালপুর

গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলরুবা শারমিন। তিনি প্রশাসনের ২৮তম বিসিএস উত্তীর্ণ। নারী ইউএনও হিসেবে কাজ করায় অনেক মেয়ের মনের কথা জানা যায়। যা হয়তো একজন পুরুষ কর্মকর্তা জানার চেষ্টাও করতেন না। এ কারণে সমস্যা সমাধান করা সহজ হচ্ছে। এমনটাই মনে করেন এই নারী ইউএনও। বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং মাদক নির্মূলে রাত-বিরাতে দুর্ধর্ষ অভিযানও পরিচালনা করেন তিনি। এমন কাজে তিনি পিছপা হতে নারাজ। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিল করার পরই তিনি দায়িত্বের পূর্ণতা পেয়েছেন বলে মনে করেন। আর এ দায়িত্ব্ পালনে এলাকাবাসীও তাকে অনেক সহযোগিতা করেন।

 

শাহীনা আক্তার, কালিহাতী

কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনা আক্তার। তিনি প্রশাসনের ২৭তম বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ। এ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হয় বাল্যবিয়ে। এ কারণে আমার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা। পাশাপাশি উপজেলায় অবৈধভাবে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধেও কাজ করে যাচ্ছেন শাহীনা। সম্প্রতি পাঁচটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে তাক লাগিয়ে দেন পুরো উপজেলায়। 

 

সাবিনা ইয়াসমিন, দেলদুয়ার

গত ৬ ডিসেম্বর বুধবার বিকালে দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিন নামে আরও একজন নারী ইউএনও যোগদান করেছেন। যোগদানের পরই নানা সমস্যা নিয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে  আলোচনা সভা করেন। সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন ইউএনও। অর্থাৎ টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার মধ্যে ৯টিতেই নারী ইউএনও দায়িত্ব পালন করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর