শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
অর্জন

ব্রিটেনের কাউন্সিলর শরিফাহ

১৮ বছর বয়সেই

সাইফ ইমন

ব্রিটেনের কাউন্সিলর  শরিফাহ

আমাদের সমাজে রয়েছে চরম বৈষম্য। এর কুফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। আমি প্রচণ্ডভাবে এটা বিশ্বাস করি যে, আমাদের সমাজে পরিবর্তন দরকার। আমাদের সবার কর্তব্য হলো বৈষম্য রোধে একসঙ্গে কাজ করে যাওয়া। মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া পরিবারে বেড়ে ওঠায় আমি গর্ব বোধ করছি। সবার মাঝে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব বলে আমি আশাবাদী   — শরিফাহ রহমান

 

ব্রিটেনের নর্থ-ইস্ট ইংল্যান্ডের ডারলিংটন বার কাউন্সিলের উপনির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী তরুণ কাউন্সিলর হয়েছেন বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার বরমরা গ্রামের কন্যা শরিফাহ রহমান। শরিফাহর বিজয়ে উত্ফুল্ল সেখানকার বাঙালি কমিউনিটির লোকজন। শরিফাহ স্থানীয় রেড হল ও লিংফিল্ড ওয়ার্ড থেকে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করেন। গত অক্টোবর মাসে বার কাউন্সিলের রেড হল এবং লিংফিল্ড ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হ্যাজেলডিন স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলে আসনটি শূন্য হয়ে পড়ে। পিতৃপরিচয়ে শরিফাহ বাংলাদেশের হলেও তার জন্ম ব্রিটেনের ডারলিংটন শহরে। বেড়ে উঠাও সেখানে। বাবা লোকমান খানের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বরমরা গ্রামে। ৭ ভাই-বোনের মধ্যে শরিফাহ সবার ছোট। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সবচেয়ে কম বয়সী এই কাউন্সিলরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন স্থানীয় এমপি জেনি চাপম্যান ও এন্ড্রুগাইন। নিউক্যাসেলের সিটি কাউন্সিলের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলর দিপু আহাদ বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশি কিংবা মুসলিম মহিলা হিসেবে নয়, অত্র এলাকায় প্রথমবারের মতো একজন তরুণী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচন হওয়াটা আমাদের সবার জন্য গর্বের ব্যাপার’। ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম এমপি রোশনারা আলীও অভিনন্দন ও প্রশংসা করেছেন শরিফাহর।

 

যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম বয়সী রাজনৈতিক

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই নর্থ-ইস্ট ইংল্যান্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী শরিফাহ রহমান। তিনি এখন যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে কম বয়সী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গত ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ডারলিংটন বার কাউন্সিলের উপনির্বাচন। লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে ৪৪.৮% ভোট পেয়ে রেড হল এবং লিংফিল্ড ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী হন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন টোরি পার্টির জোনাথন ডালস্টন। অপর প্রতিদ্বন্দ্বী লিব ডেমের হ্যারি লংমুর, গ্রিন পার্টির মাইকেল ম্যাকটিমনি এবং প্রাক্তন ইউকিপ কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী কেভিন ব্রাক। হ্যারি লংমুর পান ১১ ভোট, মাইকেল ম্যাকটিমনি পান ২০ ভোট ও কেভিন ব্রাক পান ৪৬ ভোট।

 

হয়েছিলেন বর্ণবাদী হামলার শিকার

শরিফাহর রয়েছে অতীতে মুসলিমবিদ্বেষী তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কাহিনী। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার প্রভাবে ইউরোপজুড়ে মুসলিম কমিউনিটির ওপর বর্ণবাদী আক্রমণ বেড়ে যায়। নর্থ-ইস্ট ইংল্যান্ডের ডারলিংটন শহরে হিজাব পরিহিত মহিলারা তখন মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী হামলার শিকার হন। এসব ঘটনা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন শরিফাহ। এরই একপর্যায়ে শরিফাহ নিজে এবং তার পরিবারের সদস্যরা বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছিলেন। 

 

কম বয়সেই রাজনীতিতে

অনেকটা তরুণ বয়সেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন শরিফাহ। দীর্ঘদিন যাবৎ ডার্লো ইয়াং লেবার গ্রুপের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন শরিফাহ। তখন থেকেই সমাজে বিদ্যমান নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শরিফাহ। কলেজপড়ুয়া শরিফাহর পছন্দের বিষয় ছিল আইন, রাজনীতি ও ভূগোল। কলেজ শেষ করেই শরিফাহ যোগ দিয়েছিলেন লেবার পার্টিতে। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বনর্ণবাদবিরোধী ক্যাম্পেইন চালান। বন্ধুদের নিয়েই গড়ে তোলেন একটি ইয়ুথ অ্যাকশন গ্রুপ। প্রথমবারের মতো ডারলিংটনে চালু করেন বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন স্টেন্ড আপ টু রেসিজমের স্থানীয় শাখা। বর্ণবাদবিরোধী মিটিং, মিছিল ও প্রতিবাদে যোগ দিতে চষে বেড়িয়েছেন লন্ডন, নিউক্যাসেলসহ পুরো ইংল্যান্ড। লেবার পার্টির সদস্য হওয়ার সুবাধে একান্ত সাক্ষাতের সুয়োগ হয়েছে পার্টির বড় বড় নেতাদের সঙ্গে। কথা হয়েছে পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বা ডায়ানা অ্যাবোটুদের মতো শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে। স্থানীয় এমপি জেনি চাপম্যানের সহযোগিতায় ডারলিংটনে শরিফাহ সম্প্রতি চালু করেছেন একটি পিস ক্যাম্পেইন। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কমিউনিটির মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং বর্ণবাদের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। স্থানীয় বিবিসি এবং পুলিশ বিভাগ এ কার্যক্রমে নিয়মিত সহায়তা করে যাচ্ছে।

 

ইয়ং সিটিজেন অব দ্য ইয়ার

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৬ সালে ডারলিংটন শহরের সম্মানসূচক পদক অনুষ্ঠানে শরিফাহ রহমানকে ‘ইয়াং সিটিজেন অব দ্য ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। অ্যাওয়ার্ড প্রদানকালে শরিফাহকে ব্যতিক্রর্মী ইয়াং উইমেন এবং কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

 

মেধাবী ছাত্রী

শরিফাহ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। কয়েক মাস আগে প্রকাশিত ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফলাফলে ঈর্ষণীয় সফলতা পান শরিফাহ। কুইন এলিজাবেথ কলেজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসেলে পলিটিক্স বিষয়ে গ্রাজুয়েশন কোর্স শুরু করতে যাচ্ছেন শরিফাহ। এ লেভেল পাস করার পর গ্যাপ ইয়ারে সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যখন যুক্ত ছিলেন তখনই কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ার সুযোগটি আসে। কাউন্সিলর হিসেবে বিজয়ী হওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে শরিফাহ বলেন, ‘আমার নিজের শহরের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। আমার জন্য এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি সেখানকার মানুষের জন্যই আমি এখন কাজ করতে পারছি। সামনে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে চাই।’

সর্বশেষ খবর