শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নয়ন জুড়ায় নাগরকোট

নয়ন জুড়ায় নাগরকোট

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নাগরকোটের উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ১৯৫ মিটার। এখান থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট ও অন্যান্য পর্বতের ভিউ থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সে কারণে এখানে পর্যটকের ভিড় থাকে বারো মাসই। ঘুরে এসে লিখেছেন— গাজী মুনছুর আজিজ

 

নাগরকোট যাওয়ার জন্য কাঠমান্ডুর থামেল থেকে ট্যাক্সিতে উঠি। সফরসঙ্গী বন্ধু বেলাল। নেপালের মানচিত্র অনুযায়ী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পুবে নাগরকোটের অবস্থান। ভক্তপুর জেলার বাগমাটি এলাকার একটি গ্রাম এ নাগরকোট। ট্যাক্সি কিছুক্ষণ চলার পরই শহর ছেড়ে গ্রামের দেখা পাই। গ্রামের ধুলোমাখা আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ট্যাক্সি চলছে। রাস্তার দুই পাশে নানা ফসলের খেত আছে। শর্ষের খেতও দেখি। ঠাণ্ডা লাগবে বলে গাড়ির জানালা খুলছি না, তবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আর দূরে দেখি মেঘ মাখানো সারি সারি পাহাড়।

রাস্তার বাঁকে বাঁকে আর খেতের পাশ দিয়ে বাড়িঘর আছে। অধিকাংশ বাড়িঘর কাঠের তৈরি একতলা বিশিষ্ট। বাড়িঘরগুলো খুব একটা বড়সড় নয়, কিংবা দেখতেও সুদৃশ্য নয়, তবে ছিমছাম গোছালো। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গ্রাম ছেড়ে ট্যাক্সি এবার পাহাড়ি পথে চলছে। পাহাড় কেটে কেটে তৈরি উঁচু-নিচু আর আঁকাবাঁকা এ পথ। এ ছাড়া পাহাড় ঘেঁষা এ পথের বাঁকগুলোও বেশ খাড়া। শুধু পাহাড়ই নয়, পাহাড়গুলো সবুজ গাছ-গাছালিতেও ভরা।

নাগরকোট গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে যখন ট্যাক্সি থামে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেল খুঁজতে শুরু করি। কয়েকটি হোটেল দেখে অবশেষে নাগরকোট প্যারাডাইস নামের হোটেলে উঠি। ট্যাক্সিচালক আমাদের ছেড়ে চলে যান কাল সকালে এসে আবার আমাদের নিয়ে যাবেন বলে। আগেই জেনেছি এখান থেকে ফেরার জন্য ট্যাক্সি খুব একটা মেলে না, তাই রিজার্ভ করে রাখা। আর রিজার্ভ করার পরামর্শ দিয়েছেন ট্রাভেল সলিউশন বিডি ডেস্কের হাসান ভাই। অবশ্য নেপাল ট্রিপের অনেকটা প্ল্যানই তার দেওয়া।

হোটেলে মালসামান রেখে আসি দুপুরের খাবার খেতে। কিন্তু বিকাল হওয়ায় এখানকার অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে বাসস্ট্যান্ডের পাশে ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্টে ভাত আর শাক পাই, সঙ্গে ডালও আছে। দোকানি তা-ই গরম করে দিলেন। খেতে খেতে কথা হয় দোকানির সঙ্গে। তিনি জানান, নেপালের রেস্টুরেন্টগুলোতে সকালের নাস্তা সকালে, দুপুরের খাবার দুপুরে আর রাতের খাবার রাতেই মিলবে। অর্থাৎ দুপুরে গিয়ে সকালের নাস্তা চাইলে এখানকার রেস্টুরেন্টে তা পাওয়া যাবে না। খুব স্বাদের না হলেও খেয়ে বেশ তৃপ্ত হই, কারণ স্বাদটা বেশ ছিল। ভাত শেষে টি-স্টল থেকে চা খাই। ভূগোল ঘেঁটে জানলাম নাগরকোট গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ১৯৫ মিটার উঁচুতে। এ গ্রামের বাড়িঘরগুলো পাহাড়ের কোল কেটে কেটে তৈরি। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফসলি জমিন। নেপালের অন্য অনেক দর্শনীয় স্থানের মতো এ গ্রামে ঐতিহ্যবাহী তেমন কোনো স্থাপনা নেই। তবুও এ গ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখান থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট ও অন্যান্য পর্বতমালার ভিউ থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সে কারণে নাগরকোট বারো মাসই পরিপূর্ণ থাকে পর্যটকের ভিড়ে।

সূর্য ডুবতে এখনো অনেক বাকি। আমরা তাই হাঁটা ধরি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে। উদ্দেশ্য টাওয়ার থেকে সূর্যাস্ত দেখা। বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে এ টাওয়ার। দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটছি। পাহাড়ি এ পথের দুই পাশ বড় বড় গাছ-গাছালিতে ভরা। আর ধীরে ধীরে পথটি ওপরের দিকে উঠছে। তাই আমাদের হাঁটতেও কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। আবার ঠাণ্ডাও বাড়ছে। পথে মানুষের চলাচল খুব একটা দেখি না। তবে মাঝে মধ্যে পর্যটকদের গাড়ির যাতায়াত আছে। সূর্য ডোবার অল্প সময় আগে আমরা পৌঁছি টাওয়ারের কাছে। পর্যটকদের বেশ ভিড় দেখি। পাহাড়ের চূড়ায় লোহার তৈরি এ টাওয়ার। উঠার জন্য মই আছে। আমরা ওপরে উঠি। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন পর্যটকও উঠেছেন। ততক্ষণে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপারে সূর্যটা লুকায়। সত্যিই দারুণ এ দৃশ্য। আমাদের কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা সেন্টমার্টিনের সূর্যাস্তের সৌন্দর্য যেমন আলাদা, তেমনি পাহাড়ের চূড়ায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে এ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে এভারেস্ট ভিউ থেকে সূর্যাস্তের সৌন্দর্যও অন্যরকম। ঠাণ্ডার কারণে আমাদের কাঁপুনি উঠে গেছে। ঠিকমতো ক্যামেরাও ক্লিক করতে পারছি না। তবু ভালো লাগছে। সূর্য পুরোপুরি ডুবলে তবেই নামি।

টাওয়ারের নিচে কয়েকটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট বা টি-স্টল আছে। সেখান থেকে চা খাই। সঙ্গে আমাদের দেশের জেলাপির মতো মিস্টি জাতীয় একটা খাবার খাই। তারপর রওনা হই হোটেলের দিকে।

সন্ধ্যার পর নাগরকোট গ্রামটি অন্যরকম লাগে। পথে মানুষের তেমন চলাচল নেই। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে থাকা হোটেলগুলো থেকে কিছু আলো দেখা যায়। আর কিছু হোটেল থেকে গানবাজনার শব্দ আসে। পর্যটকরা সময় কাটানোর জন্য গানবাজনায় মাতেন। রাতের খাবার খাই আমাদের হোটেলের রেস্টুরেন্টে। খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল আগেই। তবে খাবারের স্বাদ যেমন-তেমন হলেও দামটা বেজায় বেশি। খেয়ে আমরা কিছুক্ষণ হোটেলের ছাদে আড্ডা দিই।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও সূর্য উঠার কিছুক্ষণ আগে ছাদে উঠি। অবশ্য আমার সফরসঙ্গী ঘুমেই ছিলেন। ছাদে গিয়ে দেখি আরও অনেকেই আছেন। শুধু আমাদের হোটেলের ছাদেই নয়, আশপাশের সব হোটেলের ছাদেই দেখি অসংখ্য মানুষ পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে— তাদের উদ্দেশ্যও সূর্যোদয় দেখা। পাহাড় বেয়ে সূর্য উঠতে কিছুটা দেরি হলো। তবে ধীরে ধীরে তার দেখা পাই। আগুনের মতো রং নিয়ে তার উদয় হয়। এভারেস্ট ভিউয়ের এ সূর্যোদয় সত্যিই অনন্য। নাগরকোটের প্রধান আকর্ষণই এ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। সে কারণে এখানকার প্রায় সব হোটেলও পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তৈরি ও সূর্যোদয়মুখী।

সূর্যোদয় দেখে রুমে আসি। তারপর দুজন বের হই নালডুম গ্রাম দেখতে। ছিমছাম নিরিবিলি এ গ্রামের মানুষ পাহাড়ের ভাঁজের খালি জায়গায় চাষাবাদ করেন। স্থানীয় কৃষক জানান, এখানে ধান, গম, শর্ষে, বাদাম জাতীয় শস্যের চাষাবাদ বেশি হয়। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর বাসস্ট্যান্ড বা বাজারে আসি। পুরো নাগরকোটে বাজার একটাই। তবে মাঝে মধ্যে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গিফটশপ বা মুখোশ তৈরির ছোট্ট কারখানা আছে। গিফটশপ বা বাজারের দোকানিরা অধিকাংশ নারী। বাজারের এক রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে হোটেলে এসে দেখি আমাদের ট্যাক্সিচালক চলে এসেছেন। ব্যাগ ঘুছিয়ে তার সঙ্গে রওনা হই থামেলের উদ্দেশে।

 

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বিমান যায় নেপালের কাঠমান্ডু। আগে থেকে ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিমানবন্দর থেকে বিনামূল্যে অনঅ্যারাইভাল ভিসা পাবেন। তবে এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার গেলে ২০ ডলার ভিসা ফি লাগবে। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি বা মাইক্রোবাসে থামেল আসতে পারেন। ভাড়া নিবে ৬০০ থেকে ৭০০ রুপি। থামেল থেকে পরদিন সকালে নাগরকোট রওনা হতে পারেন। আসা-যাওয়ার ভাড়া ট্যাক্সিতে ২ থেকে আড়াই হাজার রুপি নেবে।

 

আবাসন ও রেস্তোরাঁ

পুরো নাগরকোটেই রয়েছে অসংখ্য হোটেল। ১ হাজার, ৫ হাজার রুপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের আছে। খাওয়ার জন্য হোটেলগুলোতে রেস্টুরেন্ট পাবেন। এ ছাড়া বাইরেও ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট আছে। নেপালি, ভারতীয়, চীনা বা থাই সব খাবারই পাবেন। নেপালি খাবার অনেকটা ভারতীয় খাবারের মতো। প্যাকেজ হিসেবে নেপালি থালি খেতে পারেন। এক থালিতে ভাত, সবজি, ডাল, সালাদ ও ভর্তা পাবেন। দাম ২৫০ থেকে ৫০০ রুপি।

 

কেনাকাটা

নাগরকোটে অল্প কিছু গিফটশপ ছাড়া তেমন কেনাকাটার জায়গা নেই। তবে নেপাল বা কাঠমান্ডুর প্রাণকেন্দ্র থামেল। গরম কাপড়, রেশমি কাপড়, চা, উপহার বা পর্যটন-স্মারক সবই পাবেন এখানে। আর কেনার আগে দরদাম করে নেবেন। কিছু দোকান এক দামের আছে। সেখানে দরদাম না করাই ভালো।

 

মনে রাখুন

বিমানবন্দর থেকে ডলার ভাঙিয়ে নিতে পারেন। থামেলেও ডলার ভাঙানোর জায়গা আছে। ভিসার জন্য পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি লাগবে। নেপালি সিমকার্ড নেওয়ার জন্যও এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে। ট্যাক্সিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারবেন। তবে দরদাম করে নেওয়া ভালো। আর শহরের মধ্যে হেঁটেই বেড়ানো ভালো। নেপাল হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। তাই কথাবার্তায় বা চলাফেরায় বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর