শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

জন্মভূমিতে যুদ্ধশিশু শামা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

জন্মভূমিতে যুদ্ধশিশু শামা

একাত্তরের যুদ্ধশিশু শামা তার কন্যা সাভানা বোনেলকে নিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসেন

একাত্তরের যুদ্ধশিশু শামা হার্ট। তাকে দত্তক নিয়েছিল এক কানাডীয় দম্পতি। সে পরিবারেই স্নেহে, আদরে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ২০ বছর আগে জেনেছেন তার জন্মভূমি বাংলাদেশের কথা। মায়ের খোঁজে, জন্মভূমির টানে সম্প্রতি নিজের মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন শামা।

আমার মা বীর। মাকে নিয়ে আমি গর্বিত। আমি কানাডার নাগরিক হলেও আমার জন্ম বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলে তা হবে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের। আমি আমার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পেতে চাই, কিন্তু এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাচ্ছি না। বাংলাদেশে আসার স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ হয়েছে...

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষেও ওপর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নারী নির্যাতনের প্রতীক হয়ে আছেন বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার যে মায়েরা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন বা সন্তান ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, নির্যাতনের শিকার যে নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, তাদের গর্ভের সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর অনেকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। তেমনই একজন যুদ্ধশিশু শামা মলি হার্ট। তার জন্ম ৬ মে ১৯৭২, মাদার তেরেসার একটি আশ্রমে। ১৯৭২ সালে কানাডায় যে কটি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম শামা মলি হার্ট। ১৯৭২ সালে কানাডার ১৪টি পরিবার ১৫টি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিল। তারা আজ মধ্যবয়সী। সেই শিশুদের মধ্যে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি। একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করতে আসা জেনেভাভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শামাকে দত্তক নেন কানাডার মন্ট্রিলের বাসিন্দা জোয়েল হার্ট ও ট্রুডি হার্ট দম্পতি। কলেজশিক্ষক জোয়েল হার্টের সেই পরিবারে রয়েছেন আটটি সন্তান। সেই পরিবারেই শামা বেড়ে ওঠেন আত্মমর্যাদা আর স্নেহ, আদরে। শামাকে দত্তক নিয়ে নতুন জীবন দান করেছেন এই দম্পত্তি। সেই শামা আজ নিজেই একজন মা। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে শিক্ষা শেষে মন্ট্রিলের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন প্রায় ২১ বছর ধরে। যুদ্ধশিশু শামা এখন প্রতিষ্ঠিত। বিয়ে করেননি। তার নিজেরও একটি কন্যা সন্তান আছে। তাকেও দত্তক নেওয়া। মা ও দেশের পরিচয় জানতে মরিয়া ছিলেন শামা। একে একে কেটে গেছে তিন দশক। এই শামার সঙ্গে ২০ বছর আগে পরিচয় হয় কানাডা প্রবাসী যুদ্ধশিশু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা চৌধুরীর। তার কাছ থেকে জেনেছেন তার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। তার সঙ্গে দেশে আশার প্রহর গুনতে শুরু করেন তারপর থেকেই। অবশেষে ৪৫ বছর বয়সী শামা আসেন তার জন্মভূমি বাংলাদেশে। সঙ্গে নিয়ে আসেন তার কন্যা সাভানা বোনেলকে। জীবনে প্রথমবার এলেন নিজের মাতৃভূমিতে। মুখোমুখি হয়ে শামা হার্ট বলেন, আমি শুনেছি একাত্তর সম্পর্কে। জেনেছি আমার জন্ম হয়েছিল কীভাবে। বাবা-মা আমাকে দত্তক নিলেন কীভাবে, এসবও জেনেছি। সত্যি বলি, আমার পরিবার কখনো আমাকে এতটুকু অবহেলা করেনি। আমি জানি না কে আমার মা, কোথায় আমার মা। কিন্তু আমার মা তার আদর থেকে এতটুকু বঞ্চিত করেননি। পুরো পরিবারের স্নেহে আমি বেড়ে উঠেছি।

বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন, সে স্বপ্ন বুকে নিয়েই কেটেছে অনেক বেলা। জন্মভূমি বাংলাদেশে আসার স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে। এখন খুঁজে ফিরছেন মায়ের পরিচয়। তিনি বলেন, মাকে সম্মান জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি মিশনারিজ অব চ্যারিটির কাছে চিঠি লিখেছিলাম। আমার মাকে সুরক্ষার জন্যই এ বিষয়ে কোনো তথ্য রাখা হয়নি। শামা বললেন, মায়ের কথা অনেক ভেবেছি। তার প্রতি খুবই অন্যায় করা হয়েছিল। আমার মা বীর। মাকে নিয়ে আমি গর্বিত। শামা আরও বলেন, কানাডায় থাকলেও বাংলাদেশে ফেরা আমার জন্য একটা স্বপ্ন ছিল। আমার মাতৃভূমিটা সত্যিই অনেক সুন্দর। আমি জানিনা, আমার আসল মাকে এখানে খুঁজে পাব কিনা। তবে চেষ্টা করব তার সন্ধান করতে। গত তিন দশক ধরে হাসপাতালের নথিপত্র আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘেঁটে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের অনেক তথ্য পেলেও মায়ের হদিস পাইনি।

তবে আশা ছাড়েননি তিনি। একদিন হয়তো মায়ের দেখা মিলবে, সেই আশায় কাটছে তার জীবন। শামা হার্টের জন্ম ঢাকার ২৬ ইসলামপুর রোডের মিশনারিজ অব চ্যারিটির শিশু সদনে। তার জন্মস্থানের কথা ভোলেননি তিনি। তাদের জন্য কানাডা থেকে লাগেজভর্তি উপহার নিয়ে এসেছেন। শিশু সদনের অনাথ শিশুদের জন্য এই উপহার। তার সেভেন গ্রেড পড়ুয়া মেয়েও সঙ্গে অর্থ উপহার এনেছেন। শামা হার্টকে দত্তক হিসেবে গ্রহণকারী কানাডীয় মাও উপহার পাঠিয়েছেন শিশু সদনের এখনকার বাসিন্দাদের জন্য। বাংলাদেশে এসে শামা হার্ট তার জন্মস্থান সেই শিশু সদনে যান তার মেয়ে সাভানা বোনেলকে নিয়ে। বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই শামা হার্ট বাংলাদেশে এসেছেন। শামা বলেন, আমি কানাডার নাগরিক। তবে বাংলাদেশ যদি আমাকে নাগরিকত্ব দিতে চায়, তবে সানন্দেই তা গ্রহণ করব। বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান অগ্রগতি ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প তাকে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশে আবার আসবেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বারবার আসব আমার বাংলাদেশে। এ দেশেই আমার জন্ম। এ দেশের মানুষকে যত দেখছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। অন্যরকম এখানকার মানুষ সত্যি ভীষণ ভালো, দেশটা সত্যি চমৎকার, এ দেশটা আমার।

একাত্তরের যুদ্ধশিশু শামার গল্প সবাইকে আপ্লুত করে।

সর্বশেষ খবর