শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফুটবল বালিকার কথা

আবদুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

ফুটবল বালিকার কথা

নিজের অদম্য চেষ্টায় কিশোরী ফুটবলার আঁখি খাতুন নজর কেড়েছেন ফুটবলপ্রেমীদের। অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে একাই সামলিয়েছেন বাংলাদেশের রক্ষণভাগ। ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন আঁখি। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও বাবা-মাসহ প্রতিবেশীদের সমর্থন পেলে সব মেয়ে খেলাধুলাসহ কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারে তার আবারও প্রমাণ দিলেন গোল্ডেন বুটকন্যা আঁখি।

শৈশবেই চোখে স্বপ্ন বুনেন বড় ফুটবলার হওয়ার। বুকে সেই প্রত্যয় নিয়ে ছুটছেন গোল্ডেন বুটকন্যা আঁখি। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে প্রমাণ করেছে আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র ঘরের মেয়েরাও দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে খ্যাতি। ২০০৩ সালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর শহরের পারকোলা গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম আঁখির। বাবা আকতার হোসেন ও মা নাছিমা বেগম দুজনই তাঁত শ্রমিক। ২০০৯ সালে আঁখি স্থানীয় পারকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ক্লাস ওয়ানে পড়া অবস্থায় ছোট্ট আঁখি বড়দের ফুটবল নিয়ে খেলার চেষ্টা করত। ফুটবল তাকে আকর্ষণ করত।

বিষয়টি স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক মনসুর আলীর নজর এড়ায়নি। ২০১২ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় দেশে প্রথম বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে আঁখির নাম লেখানো হয়। ছোট মেয়ে হলেও বাম পায়ের লম্বা ফ্রি-কিকে খুবই পারদর্শী হওয়ায় আঁখি ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করে। প্রথমে পৌরসভা পর্যায়ের খেলায় ছোট্ট আঁখি সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেয়। এরপর একে একে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে  শীর্ষ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে খেলে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে আন্তক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত খেলে পুরস্কার পায়। রাজশাহীতে ডিসি কাপ টুর্নামেন্ট ও বিভাগীয় কমিশনার কাপ টুর্নামেন্টে তার খেলা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও বিকেএসপির কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৬ সালে বিকেএসপির বাছাইপর্বে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টিমে টিকে যায়। এরপর ঢাকায় ক্যাম্পে ১৮ জনের মধ্যে টিকে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ খেলার জন্য তাজাকিস্তানে যায়। সেখানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল খেলায় চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ও মেডেল পুরস্কার পায়। এরপর বিকেএসপি কর্মকর্তারা তাকে চয়েজ করে বিকেএসপিতে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি করে নেয়। বিকেএসপির হয়ে ইন্ডিয়া সুব্রত কাপ, জাপানে দুবার, চীন, সিঙ্গারপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ফ্রেন্ডশিপ ম্যাচে অংশ নেয়। এরপর আবারও অনূর্ধ্ব-১৬ টিমের বাছাইপর্বে ৫০ জনের মধ্যে টিকে আন্ডার-১৬ ম্যাচ খেলে। বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ মূল পর্ব খেলতে থাইল্যান্ডে যায়। বাফুফের ন্যাশনাল টিমের হেড কোর্স গোলাম রব্বানী ছোটনের ডাকে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ খেলায় অংশগ্রহণ করে। ডিফেন্ডার হয়েও দুই গোল করে। ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। আর টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে গোল্ডেন বুট পুরস্কার পায়। গড়নে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় আঁখি পায় বাড়তি সুবিধা, যা অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখে তাকে। লম্বা ফ্রিকিকেও পারদর্শী। বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগের এক অতন্দ্রপ্রহরী সে। বয়সভিত্তিক খেলায় নাম্বার ওয়ান চয়েস এখন আঁখি। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা আবার নতুন করে আঁখির মধ্যে কায়সার হামিদকে খুঁজে পেয়েছে।

আঁখির সফলতায় সিরাজগঞ্জবাসী গর্বিত হয়েছে। এ জন্য প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি, শিক্ষক, সহকর্মী সবাই আঁখিকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সংবর্ধনা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলার সময় আঁখি জানান, ‘যখন গ্রামে খেলতাম নানাজনে নানা মন্তব্য করতেন। কিন্তু খেলার প্রতি আগ্রহ থাকায় পিছপা হইনি। এখন টিভি ও পত্রিকায় খবর দেখে অনেকে সাধুবাদ জানাতে আসছেন।’ আঁখি জানান, স্কুলের কোচ মনসুর স্যার সাপোর্ট করেছেন। বড় ভাই সঙ্গে নিয়ে মাঠে প্র্যাকটিস করিয়েছেন। মোবাইলে ভালো খেলোয়াড়দের খেলা দেখিয়ে অনুসরণ করতে বলেছেন। আমিও চেষ্টা করেছি। মূলত স্যার ও পরিবারের সবার অনুপ্রেরণা আমাকে এতদূর এনেছে।

আঁখির বাবা আকতার হোসেন জানান, ‘সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ খেলায় তাকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা দিলে হৃদয়টা কতটা আনন্দে ভরে উঠেছিল তা বোঝাতে পারব না। আঁখি যেন খেলার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলার লাল-সবুজের পতাকার মান উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এ জন্য সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করি।’

আঁখির মা নাছিমা খাতুন জানান, ‘আঁখিকে খুব কষ্ট করে বড় করেছি। ঠিকমতো খেতেও দিতে পারিনি। শীতের রাতে অন্যের ঘরে থাকতে হয়েছে। কষ্টের মাঝেও আঁখির সফলতায় আমরা গর্বিত।’

আঁখির স্যার ও পারকোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনসুর আলী জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই আঁখি খুব ভালো খেলত। বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট থেকে এখনো তার পায়ের জাদুতে দর্শক মুগ্ধ হয়ে যায়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর