শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রথম নারী মোটরগাড়ি চালক

সাইফ ইমন

প্রথম নারী মোটরগাড়ি চালক

ঘটনাবহুল দীর্ঘ এ যাত্রায় একই সঙ্গে রচিত হয় বিশ্বের প্রথম গাড়ির প্রদর্শন, প্রথম গাড়ি বিকল হওয়া, প্রথম গাড়ি মেরামত করা এবং প্রথম ফিলিং স্টেশন ব্যবহারের ইতিহাস। একই সঙ্গে এটি ছিল স্বামীর অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ারও প্রথম ঘটনা। চলার পথে গাড়ির ব্রেক-শু ক্ষয় হয়ে গেলে বার্থা স্থানীয় এক মুচির দোকানে নিয়ে সেটা ঠিক করিয়ে এনেছিলেন। আবার চামড়ার তৈরি বেল্টটিকেও টাইট করে নিয়েছিলেন। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম গাড়ি মেরামতকারী দোকান।
 

বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়ির জন্য মন কাঁদে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে পিত্রালয়ে। যেখানে তার জন্ম-বেড়ে ওঠা। এর জন্য কোনো বাধাই যেন শেষ পর্যন্ত বাধা থাকে না। এটা চিরন্তন সত্য। তেমনই একজন বার্থা বেঞ্জ। ঘটনা ১৮৮৮ সালের ৫ আগস্ট। বাবার বাড়ির উদ্দেশে এ নারী রীতিমতো বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বার্থা বেঞ্জ তার স্বামীর নব-আবিষ্কৃত তিন চাকার মোটরগাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন স্বামীকে না জানিয়েই। তখন ছিল না কোনো গাড়ি চলাচলের উপযোগী পথ। শুধু ঘোড়ার গাড়ি চলতে পারে এমন উঁচু-নিচু মাটির পথে ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তার বাবার বাড়িতে পৌঁছে ছিলেন। আর এ দুঃসাহসী অভিযানের মধ্য দিয়েই তিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়ে নেন খোলা রাস্তায় বিশ্বের প্রথম গাড়িচালক হিসেবে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রচিত হয় বিশ্বের প্রথম গাড়ি প্রদর্শন, প্রথম গাড়ি বিকল হওয়া, প্রথম গাড়ি মেরামত করা এবং প্রথম ফিলিং স্টেশন ব্যবহারের ইতিহাস। একই সঙ্গে বলা যায়, এটি ছিল স্বামীর অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ারও প্রথম ঘটনা।

বার্থা বেঞ্জ ছিলেন বিশ্বের প্রথম মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৪৯ সালে জার্মানির ফোরজেইম শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জার্মান প্রকৌশলী কার্ল বেঞ্জের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৮৭২ সালে। বিয়ের আগেই বার্থা তার হবু স্বামীর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন যৌতুকের অংশ হিসেবে। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী বার্থার সঙ্গে মিলে কার্ল বেঞ্জ মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেঞ্জ এবং কাই প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরই কার্ল যন্ত্রচালিত গাড়ি তৈরির গবেষণা শুরু করেন। ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম মোটরচালিত গাড়ি তৈরি করেন। তিন চাকার প্রথম মোটরগাড়িটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ মাইল বেগে চলতে পারে। জার্মান আইনে তখন বিবাহিত নারী কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারত না।

মোটরগাড়িটির স্বত্ব লাভ করেন কার্ল বেঞ্জ। তিনি ওয়ার্কশপে নীরবে-নিভৃতে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করতেন। কাজেই মোটরগাড়ি আবিষ্কারের পর সেটিকে আরও উন্নত করতেই দুই বছর কেটে যায়। ১৯৮৮ সালের ৫ আগস্ট মতান্তরে ১২ আগস্টে বার্থা তার দুই ছেলেকে নিয়ে তিন চাকার মডেল-৩ গাড়িটি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তাদের গন্তব্য ছিল জার্মানির মেইনহ্যাম শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর ফোরজেইমে অবস্থিত বার্থার মায়ের বাড়ি। কার্লকে না জানিয়েই বার্থা তার ১৫ ও ১৩ বছর বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ভোর ৫টার দিকে। কার্লের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি রেখে এসেছিলেন বার্থা। কিন্তু মোটরগাড়ি চলাচলের জন্য সে সময় রাস্তাঘাট উপযুক্ত ছিল না। কোনো পেট্রল স্টেশন ও গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ ছিল না। তার চেয়ে বড় বিষয় গাড়িটি এত দূরের পথ যেতে পারবে কিনা তাও নিশ্চিত ছিল না। যাত্রাপথে প্রথম সমস্যা দেখা দেয় উত্তপ্ত ইঞ্জিনকে ঠাণ্ডা করার পানি নিয়ে। বার্থার দুই ছেলেকে একটু পরপর নদী, ঝরনা থেকে পানির সন্ধান করতে হচ্ছিল। এরপরেই দেখা দিল পেট্রলের সমস্যা।

গাড়ির পেট্রল শেষ হয়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে অতিরিক্ত কোনো পেট্রল ট্যাংক ছিল না।

বার্থাকে এক ফার্মেসি থেকে বেনজিন কিনতে হয়েছিল। সেই ফার্মেসিই বিশ্বের প্রথম পেট্রল স্টেশন বলা যায় এ হিসেবে। কিছুদূর যাওয়ার পরই গাড়ি হঠাৎ বিকল হয়ে যায়। ইঞ্জিনের তেল সরবরাহের লাইনে ময়লা জমে ব্লক সৃষ্টি হয়েছিল। বার্থা তার হ্যাট থেকে পিন খুলে তা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়েছিল। তারপর একটি তার বার বার উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, তাই বার্থা তার মোজার রাবার ব্যান্ড দিয়ে সেটাও ঠিক করে ফেলেন। বার্থা শুধু বিশ্বের প্রথম নারী গাড়িচালকই নন, একই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম মোটরগাড়ির মেকানিকও।

অবশেষে সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিরাপদেই তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন। এ ঘটনার পরে কার্ল মিউনিখে তাদের গাড়িটির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। তখন সেটি ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। কার্ল উদ্ভাবনের জন্য গোল্ড মেডেলও অর্জন করেন। বেঞ্জ দম্পতির নির্মিত প্রতিষ্ঠানটিই আজকের মার্সিডিজ বেঞ্জ। বিশ্বের অন্যতম সেরা গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠা হিসেবে আমরা মার্সিডিজ বেঞ্জকে চিনি। বার্থা বেঞ্জের অসাধারণ উদ্যোগ আর দুঃসাহসী অভিযানের কল্যাণে পৃথিবী প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত মোটরগাড়ি সবার দৃষ্টিগোচর হয়। যে পথ ধরে মার্থা বেঞ্জ তার ঐতিহাসিক অভিযান সম্পন্ন করেছিলেন সে পথে বেঞ্জ মেমোরিয়াল পথনির্দেশক চিহ্ন স্থাপন করেছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। জার্মানির মেইনহ্যামে গেলে সে পথটি খুঁজে বের করা যাবে। তিনি ১৯৪৪ সালে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

 

একনজরে বার্থা বেঞ্জ

♦ ১৮৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন জার্মানিতে।

♦ বিশ্বের প্রথম মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

♦ বিশ্বের প্রথম যন্ত্রচালিত গাড়ি আবিষ্কারক জার্মান প্রকৌশলী কার্ল বেঞ্জের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৮৭২ সালে।

♦ বিশ্বের প্রথম নারী গাড়িচালক।

♦ কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া উঁচু-নিচু পথে টানা ১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালান।

♦ ১৯৪৪ সালে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

সর্বশেষ খবর