শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বছরে আয় হবে ১০-১৫ লাখ ডলার

দেশের প্রথম কারাগার গার্মেন্ট

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

দেশের প্রথম কারাগার গার্মেন্ট

একটি গার্মেন্টে কাজ করছে শ্রমিকরা। চলছে মেশিন। যার যার মেশিন নিয়ে সে সে ব্যস্ত। কেউ ওভার লক চালাচ্ছে। কেউবা সুইং মেশিন। কেউ সুতা কাটছে আবার কেউবা ইস্ত্রি করছে। পাশের জামদানি উৎপাদন কেন্দ্রে ঠক ঠক শব্দে তাঁতের মেশিনে কাজ করে যাচ্ছে কয়েকজন। তাদের সবাই ড্রেসকোড মেনে একই ড্রেস পরেছে। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। এদিক-ওদিক তাকানোর সময় তাদের নেই। অভূতপূর্ব এ দৃশ্যপট কোনো সাধারণ গার্মেন্টের নয়। এটি বাংলাদেশের একটি কারাগারের অভ্যন্তরের দৃশ্য। শ্রমিকরা সবাই কোনো না কোনো সাজায় কারাগারে বন্দী। আর বাংলাদেশের প্রথম কারাবন্দীদের নিয়ে গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে। কারা গার্মেন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিজিলিয়ান্স’। প্রথম অবস্থায় ৫৪টি নিট মেশিন নিয়ে শুরু হওয়া এই গার্মেন্টে ৩০০ কারাবন্দী কাজের সুযোগ পাবে। কারাগারের ভিতর ৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই গার্মেন্টের পাশেই রয়েছে জামদানি উৎপাদন কেন্দ্র। কেন্দ্রটিতে ১০টি তাঁতের সাহায্যে তৈরি করা হচ্ছে জামদানি পণ্য। গার্মেন্টে প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা। পূর্ব অভিজ্ঞ কয়েদি থাকলে তাদের অগ্রাধিকারও দেওয়া হবে। এদিকে কারা গার্মেন্ট শুরুতেই বাজিমাত করেছে। গার্মেন্ট কারখানাটির সম্প্রতি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনই ৯০ হাজার পিস ব্ল্যাক পলো টি-শার্টের অর্ডার দিয়েছেন বিকেএমইএ সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। যা জানুয়ারি মাস থেকেই উৎপাদনে যাবে।

কারাগার গার্মেন্টের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে এমপি সেলিম ওসমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই নারায়ণগঞ্জ কারাগারে নির্মিত ‘রিজিলিয়ান্স’ নামের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি ও জামদানি পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র, ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা যেতে পারে। এ ছাড়া দেশি সাব কন্ট্রাক্ট তো আছেই। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সরাসরি বিদেশে পণ্য রপ্তানি করা যেতে পারে। তাহলে ২০১৮ সালের মধ্যেই ছোট এই কারখানা থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। যেখানে ২০ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বায়ারদের যদি বিশেষ ব্যবস্থায় কারাগারের ভিতরে কারখানা পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে তবে দেখা যাবে যে পণ্যটি আমরা ১২ ডলার বিক্রি করতে পারি সেগুলো তাদের কাছে ১৪ ডলারে বিক্রি করতে পারছে। ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার গার্মেন্ট ও জামদানি পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র, ৬ তলা বিশিষ্ট সেল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।

এদিকে কারাগারে কর্মরত গার্মেন্টের বেশ কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, তারা যে অপরাধ করেছে এর জন্য তারা অনুতপ্ত। বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে যেন তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে এ জন্যই এই পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করছে। তাছাড়াও এখানে কাজ করলে বেতন পাওয়া যাবে আর বন্দীদশায় থেকেও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, সে কারণেও তারা এই গার্মেন্টে কাজ করতে পেরে খুশি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাব্বী মিঞা জানান, যেহেতু নারায়ণগঞ্জ হচ্ছে নিট গার্মেন্টের জন্য প্রসিদ্ধ। আর বন্দীরা অপরাধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। তারা কোনো না কোনোভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এই যে কারাবন্দী, তারা কারা অভ্যন্তরে অলস থেকে থেকে কোনো বড় অপরাধীর সংস্পর্শে এসে আরও বড় ধরনের অপরাধী হওয়ার সুযোগ থাকে। পরে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে না গিয়ে দেখা যায় সমাজে অনেক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বন্দীরা যেন পুনর্বাসিত হতে পারে, সংশোধিত হতে পারে, সেই ধারণা থেকেই এই গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ কোনো কিছু ডি ফর্ম থেকে রি ফর্ম হওয়া যার ইংরেজি নামকরণ রিজিলিয়ান্স। তিনি আরও বলেন, কারা গার্মেন্ট থেকে উৎপাদিত পণ্য যাতে বিক্রি করা যায় কিংবা বিদেশে রপ্তানি করা যায় সে ব্যাপারে আমরা বিকেএমইএ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। জানা গেছে, বন্দীদের চারিত্রিক সংশোধন করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কারা মহাপরিদর্শকের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় নারায়ণগঞ্জের বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গার্মেন্টটি তৈরিতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এ ছাড়াও স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগ, সমাজসেবা অধিদফতর, ক্রাউন সিমেন্ট, বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ, লাফার্জ সিমেন্ট, মেট্রো গার্মেন্ট রিজিলিয়ান্স প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছে।

কারা সূত্র জানায়, মূলত কারাবন্দীদের মধ্যে যাদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তাদের পর্যায়ক্রমে এই গার্মেন্টে চাকরির সুযোগ দেওয়া হবে। আর প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন যে বন্দীরা যাবজ্জীবন মেয়াদে জেলা খাটছেন তারা। তাদের মধ্যে কোনো এক্সপার্ট থাকলে তাদের নেওয়া হবে নতুবা বাইরের কোনো প্রশিক্ষক এনে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এই গার্মেন্টে যারাই শ্রম দেবেন তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত নারায়ণগঞ্জে কারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ১৮৬৪ সালে। ২০০৩ সালে এটি শহরের পুরান কোর্ট এলাকা থেকে স্থানান্তর হয়ে ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকায় ১২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। যার কয়েদি সংখ্যা এখন ২১০০।

সর্বশেষ খবর