শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিস্ময়কর

৫৬ যুবকের ড্রাম সেতু

সাইফুল ইসলাম, যশোর

৫৬ যুবকের ড্রাম সেতু

৫৬ যুবকের উদ্যোগে তৈরি হওয়া চার ফুট চওড়া ও এক হাজার ফুট দীর্ঘ ড্রাম-সেতুটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ২ জানুয়ারি বিকালে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন সেতুটির উদ্বোধন করেন। এ সময় সেখানে সেতুটির উদ্যোক্তারা ও বিপুলসংখ্যক স্থানীয় মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

শুরুর আগের কথা

যশোরের অন্যতম প্রধান দুই নদ ভৈরব ও কপোতাক্ষ। এ দুই নদের সংস্পর্শে থাকা ৩৮টি বাঁওড়ের মধ্যে ঝাঁপা বাঁওড়টি দ্বিতীয় বৃহত্তম। ৬৪০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ বাঁওড়টি ঘিরে রেখেছে রাজগঞ্জ  গ্রামকে। দ্বীপের মতো এ গ্রামটিতে বসবাস ১৫ হাজার মানুষের। কাছাকাছি রাজগঞ্জ বাজারের সঙ্গে যাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। প্রায় এক কিলোমিটার প্রস্থের এ বাঁওড়টির গভীরতা কোথাও কোথাও ১৫ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত। বাজার ওপারে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-হাসপাতাল সবই ওপারে। রাত ৯টার পর বন্ধ হয়ে যায় নৌকা চলাচল। তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ১৫ হাজার মানুষ। একটি সেতুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এলেও ঝাঁপা গ্রামের বাসিন্দাদের কপালে তা জোটেনি।

যেভাবে শুরু

বিষয়টি নিয়ে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি বৈঠকে বসে ঝাঁপা গ্রামের যুবসমাজ। পরে আরও কয়েক দফা বৈঠক হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, নিজস্ব অর্থায়নে নিজেরাই নির্মাণ করবেন সেতু। সে লক্ষ্যে গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ৫৬ জন যুবককে নিয়ে গঠন করা হয় ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এর সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল বলেন, বছরখানেক আগে আমরা ৫-৬ জন বন্ধু বাঁওড়ের পাশে বসে গল্প করছিলাম। এ সময় বাঁওড় থেকে মেশিনে বালি তোলা হচ্ছিল। বালি তোলার মেশিন রাখা হচ্ছিল প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর। এটা দেখেই শিক্ষক আসাদুজ্জামানের মাথায় পরিকল্পনা আসে, এত বড় মেশিন যদি প্লাস্টিকের ড্রাম ভাসিয়ে রাখতে পারে তাহলে এগুলো দিয়ে সেতুও বানানো সম্ভব। তার এ যুক্তি সবার মনে ধরে।

শুরু হয় গ্রামবাসীকে নিয়ে বৈঠক, ফাউন্ডেশন গঠন করে তহবিল তৈরি। টুটুল বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী এক হাজার ফুট দৈর্ঘ্যের এবং চার ফুট প্রস্থের সেতু নির্মাণ করতে ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল পাত ও ২৫০টি লোহার শিট দরকার। এগুলো নিয়ে গত আগস্ট মাসে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে শুরু হয় কাজ। ভাসমান এই সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল, রিকশা-ভ্যান, নসিমন, করিমন এমনকি প্রাইভেট, মাইক্রোবাস পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে বলে জানিয়েছেন এর উদ্যোক্তারা।

সেতুটি তৈরি হওয়ায় খুবই খুশি এলাকার বাসিন্দারা। ঝাঁপা গ্রামের বাসিন্দা বাঁকড়া কলেজের প্রভাষক আশরাফ-উজ-জামান বলেন, রাত ৯টার পর নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামবাসীর দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিতে ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের নৌকায় করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সবই ওপারে। সেতুটি তৈরি হওয়ায় গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা এখন অনেকটা সহজ হলো বলেই তিনি মনে করেন। ঝাঁপা গ্রামের শিক্ষার্থী ফাহিম জানায়, ‘সেতু হওয়ায় এখন আর নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে ও বাড়ি ফিরতে পারব’। ফাহিমের মতো খুশি আরেক শিক্ষার্থী সবুজও। এলাকার যুবক শফিকুল জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এখানে একটি সেতু নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি করে আসছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের সে দাবির দিকে কেউ কর্ণপাত করেনি। শেষ পর্যন্ত আমরাই উদ্যোগ নিয়ে এটি তৈরি করলাম। ফাউন্ডেশনের সভাপতি টুটুল বলেন, সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরুর আগে আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার ও

 জেলা প্রশাসকের দফতরে কথা বলেছিলাম। তারা সবাই সেতুটি নির্মাণের ব্যাপারে মত দেন।

ঝাঁপা বাঁওড়ে তিনজন মাঝি নৌকায় মানুষ পারাপার করেন। তাদেরই একজন শেখর চন্দ্র বলেন, সেতু হওয়ার পর আমাদের কাজ থাকবে না। আমাদের তিন পরিবারের ১৫ জনের পেট চলত এই খেয়া পারাপারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, সেতু হওয়ায় আমরাও খুশি। সেতুর উদ্যোক্তারা বলেছেন, সেতু চালু হলে আমাদের সেখানে কাজ দেবেন তারা।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি টুটুল বলেন, খেয়া পারাপারে জন্য গ্রামবাসী সপ্তাহে ৫ টাকা ও বছরে এক মণ করে ধান দিতেন মাঝিদের। এখন সেতু ব্যবহারের জন্যও একই খরচ দিতে হবে গ্রামবাসীকে। আর বাইরের মানুষদের আগের মতোই নগদ টাকা দিয়ে সেতু পার হতে হবে। এ টাকা দিয়ে তিনজন মাঝির বেতন, সেতু তৈরির খরচ ও মেরামতের খরচের ব্যবস্থা করা হবে। 

এলাকার যুবকদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঝাঁপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল হক মন্টু বলেন, এই সেতুর কারণে গ্রামের মানুষের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে। তবে এখানে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণের জন্য তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর