শিরোনাম
শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

দক্ষিণ কোরিয়ায় সেরা বিজ্ঞানী

সাইফ ইমন

দক্ষিণ কোরিয়ায় সেরা বিজ্ঞানী

বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সাফল্যের খবর প্রায়ই শোনা যায়। তাদের বিজয়গাথা গর্বিত করে আমাদের। এবার এই সাফল্যের মিছিলে যোগ হলো আরেকটি নাম। তিনি ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল। দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী এই বাংলাদেশি কৃষিবিষয়ক গবেষণায় পেয়েছেন অনন্য সাফল্য, হয়েছেন সেরা বিজ্ঞানী

দক্ষিণ কোরিয়ায় কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশি কৃষি ও জৈব প্রযুক্তিবিদ ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কার পেয়েছেন। তার পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামে। দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষিবিষয়ক সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর অধীনে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্রপ সায়েন্স’-এর বায়োএনার্জি ক্রপ রিসার্স ডিভিশনে এ পুরস্কার পান ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্ট ডক্টরাল রিসার্স ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন বায়োএনার্জি ক্রপ রিসার্স ইনস্টিটিউটে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈবিক দমন প্রক্রিয়ায় ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে ‘নিরাপদ খাদ্য ও নিরাপদ পরিবেশ’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছেন। মিষ্টি আলুর ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ নিয়ে তার গবেষণা এরই মধ্যে সফলতা পেয়েছে। কৃষি গবেষণায় বিশ্বে অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে কৃষি গবেষণায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার দিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশি ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল সেরা বিজ্ঞানীর পুরস্কারে ভূষিত হন। মিষ্টি আলুর চারা উৎপাদনের বিভিন্ন জেনারেশনে ভাইরাস রোগ কমিয়ে আনা ও মলিকুলার পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণে তিনি গবেষণা করছেন। এ ছাড়া ২০১৭ সালে তিনি মিষ্টি আলুর তিনটি ছত্রাকজনিত রোগ শনাক্ত করেন। মিষ্টি আলুতে রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ছত্রাকের বিভিন্ন জিনের প্রায় ২০০টি আংশিক সিকোয়েন্স করেছেন, যার মধ্যে ৬৯টি জিন সিকোয়েন্স জিন ব্যাংকে জমা করেছেন। ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি ‘মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীববিজ্ঞান’ বিষয়টাকে আমি ভালোবাসি। তখন আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়টা তেমন করে পড়ানো হতো না। ভারতে গিয়ে পড়ার ইচ্ছাও ছিল। সব মিলিয়ে হলো না। প্রকৃতি ভালো লাগে সব সময়-কার না ভালো লাগে। মূলত, কৃষিতে পড়তে এসে কৃষির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। এখানে এসে নতুন ফসলের ঘ্রাণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আস্তে আস্তে গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়ি। কৃষিতে পড়তে এসে দেখলাম পড়া ও গবেষণা করার অনেক বিষয় যেখানে উদ্ভিদ রোগ নিয়ে গবেষণা হয়, এর মানে তো অণুজীবের সঙ্গেই বসবাস। তাই ঠিক করি এ বিষয়েই উচ্চশিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করব। তারপর এখন এই নিয়েই আছি। গবেষণা করছি উদ্ভিদে লুকিয়ে থাকা অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক) নিয়ে, যাদের এনডোফাইট বলা হয়, যারা উদ্ভিদের ক্ষতি করে না কিন্তু উপকার করে বলে ধারণা করা হয়, তাদের বিস্তার, সম্ভাব্য উপকারিতা নিয়ে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা আর খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে।

ড. নারায়ণ চন্দ্র পালের বাবা সূর্য কুমার পাল ব্যবসায়ী আর মা কাননবালা পাল গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ২০১২ সালে বিয়ে করেন সুবর্ণা পালকে। তাদের একমাত্র সন্তান অহর্নিশ পাল (সৌহার্দ্য)। ড. নারায়ণ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন চান্দিনা পাইলট হাইস্কুলে। পরবর্তীতে মতিঝিল মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। এইচএসসিতে প্রথম বিভাগে পাস করার পর হতাশ হয়ে পড়েন। ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সে সুযোগ হয়নি। ভর্তি হন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের পরিবেশ মুগ্ধ করে ড. নারায়ণকে। সারি সারি দেবদারু গাছ, লিচু বাগান, বাঁশবাগান, সুশোভিত আমের বাগান, এক চিলতে মেঠো পথ ধানখেতের মাঝ দিয়ে, সারি সারি নারিকেল গাছ আর নাগলিংগমের সমারোহের মাঝে তার প্রেম হয়ে যায় সবুজের সঙ্গে। ২০০২ সালে কৃষি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।    

তারপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স শেষ করে একজন বন্ধুর সহায়তায় দক্ষিণ কোরিয়াতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসেন। এখানে এসে এমএস এবং পিএইচডি করেন উদ্ভিদ রোগবিজ্ঞান ও বায়োটেকনোলজি

 

বিষয়ে। ২০১২ সালে চুংনাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেই পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল। এর এক বছর পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষিবিষয়ক সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ এর অধীনে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্রপ সায়েন্স’ এ গবেষক হিসেবে কাজ করে আসছেন। ড. নারায়ণ পাল শুধু গবেষণাতেই নয়, দক্ষ সংগঠক হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘যোগাযোগ ও লিডারশিপ’ ক্লাবে যোগ দেন। এটি আমেরিকার একটি ক্লাবের অঙ্গ সংগঠন। এক সময় ক্লাবটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সংগঠনটির মূল কেন্দ্র আমেরিকা থেকে সনদপত্রও পান। ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ নই আমি। সুযোগ পেলেই ঘুরতে পছন্দ করি। লেখালেখির অভ্যাস আছে স্কুলজীবন থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমরা সমমনা কয়েকজন জুনিয়র-সিনিয়র বন্ধু মিলে বিতর্ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। শুরুতে কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০১-০২ সেশনে সভাপতির দায়িত্ব পাই। ড. নারায়ণ আরও বলেন, ছোট মামা (অব.) অধ্যাপক ডা. সমরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত আমার অনুপ্রেরণা। আমি চাই বাংলাদেশের সব কৃষকের কৃষি কার্ড এবং কৃষি বীমা থাকবে। স্বপ্ন দেখি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের লাভ কৃষকরাই পাবে।

 

সর্বশেষ খবর