শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশ্বজুড়ে বাংলা

বাংলাদেশি দুই নারীর হাতে ব্রিটিশ রানীর সম্মাননা

বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের খাতায় নারী-পুরুষ সবার সমান অংশীদারিত্ব। কেউ আজ কারও থেকে পিছিয়ে নেই। শুধু দেশের গণ্ডিতে নয়, বিশ্বপরিমণ্ডলে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সফলতার স্বাক্ষর।

তানিয়া তুষ্টি

বাংলাদেশি দুই নারীর হাতে ব্রিটিশ রানীর সম্মাননা

দেশের জন্য ঘরোয়া অর্জনও অনেক বড় ব্যাপার। সেখানে যদি দেশের কোনো সন্তানকে বিশ্বদরবার সম্মানিত করে তা নিশ্চয় আরও অনেক গর্বের বিষয়। আর এ ধরনের সম্মানিত অর্জন এমনি আসে না। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা আর মেধা দিয়েই অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশি দুই নারী সম্প্রতি ব্রিটেনের রানীর পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। মেম্বারস অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই)-এ অভিষিক্ত হলেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী ড. আনোয়ারা আলী এবং অফিসার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই)-এ ভূষিত হলেন ড. পপি জামান।

 

রাজনৈতিক অঙ্গন, সংগীতে ভূমিকা, সাহিত্যে অবদান, স্বাস্থ্য খাতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন, খেলাধুলা ও কমিউনিটিতে বিশেষ অবদানের জন্য ১ হাজার ১২৩ ব্যক্তিকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করেছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকায় এশিয়ান অন্যান্য দেশের নাগরিকসহ বাঙালি ও মুসলিমরা অন্তর্ভুক্ত আছে। এ খেতাবের ৭০ শতাংশ দেওয়া হয় যারা নিজ নিজ কমিউনিটিতে সফলতার সঙ্গে কাজ করেন। এবার যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে প্রায় ৪৯ শতাংশই নারী। তার ভিতর আবার ৯.২ শতাংশ রয়েছেন সংখ্যালঘু নারী।

 

এমবিই খেতাব পাওয়া ডক্টর আনোয়ারা আলী টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক কাউন্সিলর ছিলেন। এ তালিকায় আনোয়ারাই একমাত্র বাঙালি। স্পিটালফিল্ড প্র্যাক্টিসের জিপি ড. আনোয়ারা স্থানীয় কমিউনিটিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ খেতাব পান। সাবেক কাউন্সিলর আনোয়ারা আলী স্পিটালফিল্ডস ও বাংলা টাউনে চিকিৎসক হিসেবে সেবা দেন। কাউন্সিলর থাকার সময় তিনি টাওয়ার হ্যামলেটে ‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ এর কেবিনেট মেম্বার ছিলেন।

 

একজন চিকিৎসক হিসেবে আনোয়ারা ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ ‘ব্রেস্ট স্ক্রিনিং’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সেখানে বসবাসরত বাঙালি নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আনোয়ারা আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭০ সালে। স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটিতে তার খুবই প্রশংসা। তিনি শৈশবেই বাবা জোবেদ আলী ও মা সেলিমা খাতুনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চলে যান। আনোয়ারা সেন্ট বার্থামলুজ ও রয়েল লন্ডন মেডিকেল স্কুল থেকে ১৯৯৭ সালে এমবিবিএস পাস করেন।

 

২০০৬ সালে লেবার পার্টি থেকে টাওয়ার হ্যামলেটের বো ওয়েস্ট ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে এনএইচএস ইস্যু নিয়ে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হলে আনোয়ারা আলী দলত্যাগ করে কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন। তারপর অবশ্য তিনি আর কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হননি। এরপর থেকে তিনি ইংল্যান্ডভিত্তিক এস টেলিভিশনে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানের নিয়মিত হোস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ড. আনোয়ারা দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন চ্যানেল আই-এর ইউরোপীয় শাখার চেয়ারম্যান এবং সিইও রেজা আহমেদ ফয়সাল চৌধুরী সোয়াইবকে। এ দম্পতির ওয়াবেদ রেজা জামি চৌধুরী নামের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। 

 

এদিকে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ওবিই খেতাব পেয়েছেন ইস্ট সাসেক্সের ড. পপি জামান। পপি জামান মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইড ইংল্যান্ডের চিফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছেন। লন্ডনভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করে থাকে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে সবাইকে প্রশিক্ষণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রায় আট বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন পপি জামান। তার এ অসামান্য অবদানের জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এ অনন্য সাধারণ পুরস্কারে পপি জামানকে ভূষিত করেছেন।

 

পপি জামান ১৯৭৭ সালে পোর্টসমাউথে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের উত্তর মোলাইম গ্রাম থেকে অনেক আগেই ইংল্যান্ডে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালে পপি জামান পোর্টসমাউথে ডিপার্টমেন্ট অব হেলথে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

 

কর্মজীবনের শুরুতেই সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠানে কাজের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু। ২০০৩-০৪ সাল পর্যন্ত পপি পোর্টসমাউথ প্রাইমারি কেয়ার ট্রাস্টে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সালে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করেন। এ সময় ইংল্যান্ডব্যাপী মেন্টাল হেলথ ট্রেনিং উন্নয়নের জন্য তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তারা আবিষ্কার করেন

 

স্কটল্যান্ডে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার উপকারিতা। তারপর তিনিও জনস্বার্থে ইংল্যান্ডে এমন কিছু করতে চান। প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেন্টাল হেলথ চমৎকারভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করে। এ প্রকল্পটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পপিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ফাস্ট এইড ইংল্যান্ডের সিইও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইড ট্রেনিংয়ের জনপ্রিয়তার কারণে অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটিকে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন পপি জামান।

 

এ অর্গানাইজেশনে প্রথমত মানুষের মানসিক সমস্যা শনাক্ত করা হয়। তারপর সমস্যা থেকে রেহাই পেতে সর্বোত্তম দিক-নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রাকাল থেকেই তিনি এ প্রোগ্রামে উদ্যোগী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছেন। এ দেশে বসবাসরত ছোট ছোট কমিউনিটিতে তরুণীদের বিশেষভাবে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। যার কারণে তারা বিষণ্নতায় ভেঙে পড়েন। এ পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের জন্য পপির বিশেষ ভূমিকা থাকে। তাদের সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে খতিয়ে দেখতেন। এরপর মানসিক সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতেন। পপির এই উদ্যোগী ভূমিকা একটি-দুটি নয়, প্রায় সব কমিউনিটিতে চালানো হয়। তিনি সব জায়গায় সমান গুরুত্বের সঙ্গে তাদের প্রচারাভিযান চালাতেন। সবার মাঝে তাদের সেবা পৌঁছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টার স্বীকৃতি মিলল রানীর দেওয়া বিশেষ সম্মাননায়।

 

সর্বশেষ খবর