শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর ক্যান্সার শনাক্তকরণ যন্ত্র

বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তের এক ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন

বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর ক্যান্সার শনাক্তকরণ যন্ত্র

ছবি : জয়ীতা রায়

অভাবের কারণে একসময় অন্যের বাড়ি লজিং থেকে পড়াশোনা করতে হয়েছে ড. মোহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সিদ্দিকীর ল্যাবে উচ্চতর গবেষণা করছেন বিভিন্ন দেশের গবেষক। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করার যন্ত্র আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

ক্যান্সার এমনই ঘাতক ব্যাধি যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে শেষ পর্যায়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব হলে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তের এক ডিভাইস আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের প্যাটেন্ট লাভ করেছেন তিনি। বিশ্ববাসীর কাছে ড. সিদ্দিকীর এমন সাফল্য বাংলাদেশের সম্মানকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। সুনামগঞ্জের ছোট্ট এক গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গ্রামে কোনো হাইস্কুল না থাকায় পড়ালেখার জন্য তাকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে। মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই তার পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়। ওই বয়সেই বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থাকা শুরু করেন তিনি।

যে বছর কোথাও লজিং থাকার ব্যবস্থা হতো না সে বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকত। এভাবেই সিলেট শহরতলির রেবতিরমণ উচ্চবিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বর নিয়ে এসএসসি পাস করেন। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সেখানে পড়ার সময় টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারেও সাহায্য করতেন যথাসম্ভব। এ কারণে ক্লাস করতে পারতেন না। তবে অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি কিছুই। রসায়ন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, ‘একবার আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি ১৮০০ টাকা দিয়ে দেন খলিল স্যার। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার টাকা একাধিকবার ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এবার দেশে এসে স্যারের খবর নিয়ে জানলাম তিনি অসুস্থ, তাকে দেখতে যাইনি। অসুস্থ স্যারকে দেখলে খুব কষ্ট পাব। স্যারের কাছে আমি ঋণী।’

ড. মোহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী ছাত্রাবস্থায় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। সে সময় বন্ধুরা মিলে কয়েকটি লিটলম্যাগ প্রকাশ করতেন। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। টিউশনি শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। কারণ তার দুজন শিক্ষার্থী বোর্ডের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। এমএসসি পাসের পর তিনি ঢাকায় এসে বুয়েটে এমফিলে ভর্তি হয়েছিলেন রসায়ন বিভাগে । তখন তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল দেশের বাইরে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করবেন। এজন্য বিভিন্ন দেশে আবেদন করেন। ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর এমফিল পড়া বাদ দিয়ে সরাসরি পিএইচডি করতে চলে যান দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে যাওয়ার পর তার মধ্যে একটি পরিবর্তন আসে। তিনি বলেন, ‘এমএসসি পর্যন্ত টাকার অভাবে খুব কষ্ট করেছি। বৃত্তি পাওয়ার পর মনে হলো, পড়ব আমি টাকা দেবে ভিন্ন দেশের সরকার। তারপর মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে রাত কাটাতাম। সহপাঠীরা আমাকে পাগল মনে করত। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে আমি ব্রেইন কোরিয়া- ২১ এবং পিএইচডি গ্র্যাজুয়েট এওয়ার্ড-২০০৭ সহ আরও অনেক গুলো মেডেল লাভ করি । পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গবেষণা ছিল বিশ্লেষণী রসায়নে। আমার গবেষণাপত্র পৃথিবীর নামকরা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়। পিএইচডির পর আমি চলে যাই অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটিতে- পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী এলান বন্ডের সাথে পোস্ট ডক্টরেট করতে । মনাশ ইউনিভার্সিটিতে তিন বছর কাজের পর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে যোগ দেই ইউনিভার্সিটি অফ কুনসল্যান্ডের অস্ট্রেলিয়ার ইনস্টিটিউট ফর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনলজিতে । সেখানে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি ক্যানসার প্রথমিক পর্যায়ে নির্ণয় নিয়ে কাজ করে আসছি । এদিকে আমার আত্মীয়দের মধ্যে বেশ কয়েকজন ক্যানসারে মারা যান । তাদের মৃত্যু আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল । আর তখন থেকেই ক্যানসার প্রথমিক পর্যায়ে দ্রুততম ভাবে নির্ণয়ের সহজলভ্য এবং স্বল্পমূল্যের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন আমার গবেষণার অন্যতম প্রধান টার্গেট হয়ে দাড়ায় । তারি ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে প্রথমবার আমরা একটি ডিভাইস বানিয়েছিলাম যা দিয়ে মানুষের রক্তে অবস্থিত ক্যানসার সেল খুব সহজে নির্ণয় করা যেত । ২০১৭ সালে আমি এবং আমার কোলাবোরেটররা আরেকটি সহজ এবং স্বল্পমূল্যের পদ্ধতি উদ্ভাবন করি যা দিয়ে খুব দ্রুত মানুষের রক্তে ক্যানসারের উপস্থিতি নির্ণয় করা সম্ভব হয় ।'

ড. সিদ্দিকী ক্যান্সার শনাক্তকরণের ডিভাইস ডেভেলপমেন্টের ওপর কাজ করছেন। কীভাবে ক্যান্সারের মতো অতি ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসাকে স্বল্প খরচে করা সম্ভব হয় তার উপরেই এই বিজ্ঞানী সফলতা পেয়েছেন। তার তৈরি ক্যান্সারের শনাক্তকরণ যন্ত্রে রোগ নির্ণয় করতে খরচ পড়বে ৩ থেকে ৪ ডলার মাত্র। ড. সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের গবেষণার প্রথম ও প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো, প্রযুক্তিটা যেন নিম্ন-আয়ের মানুষের কাজে লাগে, যাদের প্রচলিত ব্যয়বহুল ক্যান্সার ব্যবস্থাপনার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। এর জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান বা কোটি টাকার যন্ত্রপাতির দরকার নেই। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ব্লাডসুগার টেস্টের মতো ক্যান্সার নির্ণয়ও সহজ হবে। বিশ্বব্যাপী যে কোনো ওষুধের দোকান থেকে নামমাত্র দামে এই ডিভাইস কেনা যাবে।

 বিশ্বের একাধিক নামকরা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আমাকে প্রপোস করেছে কিন্তু আমি চাচ্ছি বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করুক।

২০১৪ সালে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকাতে প্রতি বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ মারা যায় ক্যান্সারে। ড. সিদ্দিকী জানান, ‘একটি যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তকরণের স্বপ্ন নিয়ে আমি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে ৩ লাখ ৭২ হাজার ডলারের অনুদান পাই।

সেই অর্থায়নে আমি এবং আমার গবেষক দল এ ডিভাইস বানাই। এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়া ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের ডিভাইস বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করা সম্ভব হবে।’ বর্তমানে ড. সিদ্দিকীর অধীনে ১৩ জন গবেষক উচ্চতর গবেষণা করছেন। ক্যান্সার নিরাময়ের অন্যান্য ডিভাইস তৈরির জন্য গত ডিসেম্বরে তিনি ৪ লক্ষ ৭২ হাজার ডলার গবেষণা অনুদান পেয়েছেন। বিদেশে থেকেও তার বুকের মধ্যে বাংলাদেশকে ধারণ করেন সবসময়।

সর্বশেষ খবর