শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
কবি হেলেন কিলার

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর বিশ্বজয়

সাইফ ইমন

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর বিশ্বজয়

তিনি জন্মেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। ১৯ মাস বয়সে হারান তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও কথা বলার শক্তি।  কিন্তু অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছিল তার সব প্রতিকূলতা। সব প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি হয়ে আছেন বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণীয় দৃষ্টান্ত—

 

দৃষ্টিশক্তি, কথা বলার ক্ষমতা, শ্রবণশক্তি ইত্যাদি মানুষের অতি মূল্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এসব ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে মানুষ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই পৃথিবীতেই অনেক মানুষ আছে যাদের নেই দৃষ্টিশক্তি, নেই কথা বলার ক্ষমতা, নেই শ্রবণ শক্তি। এই রকম জীবন যেন বেঁচে থেকেও মৃত থাকা। কিন্তু এরূপ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ নিজ গুণে তাদের নিজেদের করেছেন মহিমান্বিত ও সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। তেমনই একজন হলেন হেলেন কিলার। পুরো নাম হেলেন অ্যাডামস কিলার। সম্পূর্ণ অন্ধ যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কবিতাও রচনা করেছেন।

হেলেন মোট ১১টি বই রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দি স্টোরি অব মাই লাইফ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর, আউট অব দি ডার্ক ইত্যাদি। তিনি বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেন যেখানে তিনি নিজেই নিজ ভূমিকায় অভিনয় করেন। তার আরও কিছু অসাধারণ প্রতিভা ছিল। যেমন তিনি বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই তাতে কী সুর বাজছে তা বলতে পারতেন। এমনকি দীর্ঘদিন পরেও কারও সঙ্গে হাত মেলালে বলে দিতে পারতেন লোকটি কে। তার স্পর্শের অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি নৌকা চালাতে পারতেন। নকশি কাঁথা সেলাই করতে পারতেন। তিনি দাবা, তাসও খেলতে পারতেন। ১৯৫৯ সালে হেলেন জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন বিভিন্ন হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি যুদ্ধাহত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সৈনিকদের উৎসাহিত করতেন, সাহস জোগাতেন, আশার কথা শোনাতেন। যুদ্ধ শেষে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। হয়ে ওঠেন বিশ্বজুড়ে সবার অনুপ্রেরণা।

১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আলবামার তুসকাম্বিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এ মহীয়সী নারী। তার বাবার নাম আর্থার কিলার এবং মায়ের নাম ক্যাট অ্যাডামস কিলার। তিনি একাধারে একজন লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী। হেলেনের বয়স যখন ১৯ মাস তখন তিনি

মারাত্মকভাবে জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের প্রভাবে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় তিনি অন্ধ হয়ে যান। সেই সঙ্গে শ্রবণ শক্তি হারান। ফলে আর কথা বলতে শিখতে পারেননি। তার বাবা-মা তার চিকিৎসা চালিয়ে যান। ৬ বছর বয়সে হেলেনকে টেলিফোন আবিষ্কারক বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। গ্রাহামবেল তখন অন্ধ ও বধিরদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। হেলেনকে পরীক্ষা করে জানালেন হেলেন আর কোনোদিনই দেখতে বা শুনতে পারবেন না। তবে হেলেনের বুদ্ধিমত্ত্বায় আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল মুগ্ধ হন। তিনি তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী হেলেনকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে বলেন। এতে হেলেনের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে জানান। শুরু হয় হেলেন কেলারের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। অ্যানি সুলিভান নামের এক গৃহশিক্ষিকা সার্বক্ষণিক তার পাশে থাকতেন। তার সহযোগিতায় মাত্র ৮ বছর বয়সেই হেলেন হাতের আঙ্গুল দিয়ে দাগ কেটে কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়াসহ শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ শিখে ফেলেন। তারপর তাকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করান। আর ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে কথা বলা শেখেন হেলেন। ১৪ বছর বয়সে হেলেন ‘রাইট হামসন’ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯০০ সালে তিনি রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন। এর চার বছর পর বিশ্বের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে হেলেন অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। রেডক্লিফ কলেজে পড়ার সময় হেলেন কথা বলতে শেখে

এবং মুখে পড়ার অনুশীলন করে। এভাবেই হেলেন কথা বলা এবং লেখাতে দক্ষ হয়ে ওঠে।

হেলেন রাজনৈতিক বিষয়েও ছিলেন খুব সচেতন। রাজনীতি নিয়েও লেখালেখি করেছেন প্রচুর। হেলেন ছিলেন আমেরিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থক। তিনি পার্টিতে ১৯০৯ সালে যোগদান করেন আনুষ্ঠানিকভাবে। তিনি সমাজের সব মানুষের মাঝে আয়ের সুষম বণ্টন দেখতে চাইতেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসমতার বিরুদ্ধে তিনি প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার বই ‘‘Out of The Dark এ এই বিষয়ে তার লেখাগুলো স্থান পেয়েছে। ১৯১২ সালে তিনি Industrial Workers of the World (IWW) এ যোগদান করেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অন্ধদের কল্যাণে উৎসর্গ করেন।

অন্ধদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে গড়ে তোলেন নতুন নতুন সমিতি ও স্কুল। সমাজের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও গণমানুষের সহায়তা অর্জনে হেলেন প্রচেষ্টা চালান। তার জীবদ্দশাতেই আমেরিকার সব রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, মার্ক টোয়েন, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিগণ তাকে সহায়তা পাঠান। তিনি ১৯১৫ সালে জর্জ কেসলারকে সঙ্গে নিয়ে ‘হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলেন। তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি ওভারসিজ ব্লাইন্ড’ গঠিত হয়। যার বর্তমান নাম হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল। এর আগে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই হেলেন কিলার পরলোকগমন করেন।

সর্বশেষ খবর