শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রিকশাচালক জয়নালের মমতাজ হাসপাতাল

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

রিকশাচালক জয়নালের মমতাজ হাসপাতাল

চরাঞ্চলের ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি জয়নাল আবেদিন। রিকশায় প্যাডেল ঘুরিয়ে কাটিয়েছেন জীবনের ৪০টি বছর। যে জয়নালের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেই জয়নালই এখন গরিবের বন্ধু। রিকশা চালানোর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তুলেছেন ‘মমতাজ হাসপাতাল’। মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে অসহায় গরিবদের দিচ্ছেন চিকিৎসাসেবা। এ ছাড়াও অজপাড়া গাঁকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্যও প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

 

যে ভাবনা থেকে শুরু

গ্রামের ভূমিহীন কৃষক মো. আবদুল গনির চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে জয়নাল সবার বড়। অভাবের সংসারে কারোরই লেখাপড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর এক রাতে জয়নালের বাবার হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়। প্রত্যন্ত এলাকায় সে সময় কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক না থাকায় ভোর হওয়ার আগেই জয়নালের বুকে মাথা রেখে তার বাবার মৃত্যু হয়। বিনা চিকিৎসায় বাবার মৃত্যু জয়নালকে করে নীরব নিথর। সেই থেকে স্বপ্ন দেখেন গ্রামে একটি হাসপাতাল করার। নিজের মনের ভিতরকার সুপ্ত সেই বাসনা ১৬ বছর আগেই বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

বাবার মৃত্যুর পর পরই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান জয়নাল। এরপর রিকশা চালিয়ে অল্প করে অর্থ জমাতে শুরু করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টে অর্জিত অর্থের বেশিরভাগই ব্যাংকে জমাতেন। ২০০১ সালে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়ে হাসপাতাল করার জন্য বাড়ি ফেরেন। তখন ২৪ শতাংশ জমি ৪০ হাজার টাকায় কিনে ছোট একটি আধা পাকা টিনশেড ঘর তৈরি করে জয়নাল তার মেয়ের নামে শুরু করেন মমতাজ হাসপাতালের কার্যক্রম।

 

যেখানে হাসপাতাল

ময়মনসিংহ শহর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে প্রায় ১৭ কিলোমিটার মেঠোপথ পেরিয়ে চর এলাকা (সাবেক সদর উপজেলার অংশ) বর্তমানে গৌরীপুরের পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টান হাসাদিয়া গ্রামে এ হাসপাতালের অবস্থান। ওই এলাকার মানুষের জন্য কয়েক বছর আগে গ্রাম থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে একটি সরকারি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র  তৈরি হয়েছে। আর চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহে আসতে পাকা রাস্তায় গ্রামবাসীকে ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হয়। আর বর্ষায় ট্রলারে করে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালে যেতে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।

 

হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা

একটি বড় আধাপাকা ঘর। এর একটি কক্ষে অতি পরিচ্ছন্ন চৌকিতে সাদা চাদরে তিনটি বিছানা পাতা পুরুষ রোগীর জন্য। পাশের কক্ষে রয়েছে মহিলাদের জন্য তিনটি বেড। প্রতিটি বিছানার মাথার কাছে রয়েছে স্যালাইন দেওয়ার স্ট্যান্ড। অন্য কক্ষগুলোতে ফার্মেসি আর চিকিৎসকের বসার রয়েছে পৃথক ঘর। সাধারণ চিকিৎসার ৩০-৩৫ জাতের ওষুধ নিয়মিত থাকে সেখানে।

 

যেভাবে হাসপাতাল চলে

প্রথম থেকেই স্থানীয় পল্লীচিকিৎসক মো. আলী হোসেন শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী দেখেন। আর এর জন্য প্রতি মাসে তিনি জয়নালের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে নিচ্ছেন পারিশ্রমিক। আর প্রথমদিকে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক সপ্তাহে একদিন বৃহস্পতিবার ৭০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে রোগী দেখতে আসতেন। এখন মাসে একদিন করে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক আসছেন হাসপাতালটিতে।

 

যেসব সেবা দেওয়া হয়

জ্বর, পেট, মাথা ও বুক ব্যথাসহ বাতের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি, রক্তচাপ, অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা, সর্দি কাশি, গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পাতলা পায়খানাসহ প্রাথমিক রোগের সব ধরনের পরামর্শ মিলছে এই হাসপাতাল থেকে। তবে ওষুধ সংকটের কারণে পরামর্শপত্রে লেখা সব পদের ওষুধ পান না অনেকে।

 

পেয়েছেন সাদা মনের খেতাব

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক রোড শো চলাকালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের পক্ষ  থেকে জয়নালকে সাদা মনের মানুষ হিসেবে সনদ ও পদক দেওয়া হয়। সিঙ্গার-চ্যানেল আইর সাহসী কিংবদন্তি অনুষ্ঠানে মনোনীত হন জয়নাল আবেদিন। ২০১১ সালের ১৯ নভেম্বর ৪০তম জাতীয় সমবায় দিবসে জয়নালকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

 

রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়

শুধু চিকিৎসা সেবাই নয়, দরিদ্র হাসাদিয়া গ্রামকে আলোকিত করার জন্য ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন টান হাসাদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে ১৮০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক সংখ্যা ৫। গেল বছর সরকারি অর্থায়নে হয়েছে নতুন আরেকটি ভবন।

 

জয়নালের বক্তব্য

‘আমার এই শেষ বয়সে তেমন কিছু চাওয়ার নেই। এলাকার মানুষ যে এখানে আসেন এটাই আমার বড় পাওয়া। হয়তো জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না এখানে একটি ভালো হাসপাতাল ও বিদ্যালয় হয়েছে। এলাকার মানুষ পূর্ণাঙ্গভাবে সব রকম সেবা নিচ্ছে, ছেলে- মেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, ধীরে ধীরে এলাকার মানুষ আমার এ কাজে এগিয়ে আসবে। কেউ না কেউ সহযোগিতার হাত বাড়াবেই। এ দেশে এখনো অনেক ভালো মানুষ রয়েছেন।’

সর্বশেষ খবর