শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বগুড়ার মূক-বধির স্কুল

উত্তরের আলো

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

উত্তরের আলো

১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রাচীন এই বিদ্যালয়ে হাজার হাজার মূক-বধির শিশু শিক্ষা নিয়ে স্বাবলম্বী হলেও সরকারের নজর পড়েনি এখনো।

খুকি, বগুড়ার গাবতলীর কালাইহাটা গ্রামের ছয়ফলের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়। সে কথা বলতে ও শুনতে পারে না। মূক ও বধির প্রতিবন্ধী খুকির বাবা মারা যাওয়ার পর মা চলে যায় স্বামীর সংসার ছেড়ে অন্যত্র। বাবা-মা হারিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে এই শিশুটি। শুধু খুকি নয়, তার ছোট বোন রুমাও প্রতিবন্ধী। ছোট ভাই হাকিমকে নিয়ে এই তিনজনের ঠাঁই হয় নানা বাড়িতে। কিন্তু কিছুদিন পরই নানা মারা গেলে তাদের দায়িত্ব এসে পড়ে মামার ওপর। মূক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী দুই ভাগ্নিকে নিয়ে বিপাকে পড়েন অন্যের দোকানে কাজ করা মামা আসাদ। এ অবস্থায় খোঁজ পান বগুড়া জেলা শহরে মূক-বধির বিদ্যালয়ের। আবাসিক এবং অনাবাসিক দুই ব্যবস্থা রয়েছে বেসরকারি এই বিদ্যালয়টিতে। আর এখানেই মামা নিয়ে আসেন খুকিকে। আশ্রয় হয় বিদ্যালয়ের আবাসিক ব্যবস্থায়।

বগুড়ার ধুনটের শৈলমাড়ী এলাকার হতদরিদ্র আশরাফুলের ছেলে নাজমুল। সেও মূক-বধির প্রতিবন্ধী। নাজমুলকে এই স্কুলে রেখে ৬ মাসেও খোঁজ নিতে আসেননি তার বাবা-মা। বারবার বাড়িতে খবর দেওয়ার পরও স্কুল ড্রেস দেওয়ার সাধ্য হয়নি নাজমুলের দরিদ্র বাবা-মার। অবশেষে গত ডিসেম্বর মাসে শিক্ষকদের বেতন থেকে দেওয়া হয় নাজমুলের পোশাক কেনার টাকা। শুধু এই দুজনই নয়, বিদ্যালয়ে ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে এমন অনাথ শিশুর সংখ্যা দেড় শতাধিকেরও বেশি।

চলতে ফিরতে পারলেও এরা কথা বলতে পারে না। শুধু কথা বলতেই পারে না তা নয়, এরা কানেও শুনতে পারে না। এরপরও এরা সবাই এক সঙ্গে শৃঙ্খলভাবে শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা করছে। ওরা সবাই এক ধরনের অসহায় পরিবারের মূক ও বধির প্রতিবন্ধী সন্তান। আর উত্তরাঞ্চলের এমন অসহায়দের একমাত্র ঠিকানা বগুড়া মূক-বধির বিদ্যালয়। এখানে অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বিশেষায়িত এই বিদ্যালয়ের অবস্থান বগুড়া শহরের কলোনি এলাকায়। আর এই বিদ্যালয়টিতে অসহায় এসব মূক ও বধির প্রতিবন্ধীরা পড়াশোনা করে নিজেদের সমাজে স্বাবলম্বী করে তুলছে। এসব মূক ও বধির প্রতিবন্ধীকে এক ধরনের ইশারার মাধ্যমে পড়াশোনা করাচ্ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এই মূক-বধির বিদ্যালয়টি এভাবেই উত্তরাঞ্চলে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে অধ্যয়নরত এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় কৃতিত্ব দেখিয়েছে। বিভিন্ন সময় অঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও পেয়েছে। এ বছরও দুই শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রীর ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডে ব্যবহূত আঁকা ছবির জন্য মো. সৌরভ খান ও কাজী ফিরোজ মাহমুদ বাপ্পি পেয়েছে ১ লাখ টাকা করে আর্থিক সম্মানী। ২০১২ সালে ৮ম জাতীয় শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইমামুল হাসান নামের এক মূক-বধির শিক্ষার্থী সেরা পুরস্কার অর্জন করে। এই শিক্ষার্থী এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বগুড়া শহরের নাড়ুলিয়া এলাকায় তার বাড়িতে একটি আর্ট স্কুল গড়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, এ বছর জেএসসি পরীক্ষায় সাতজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সাতজনই উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে নেই সরকারের সামান্যতম অনুদান। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রাচীন এই বিদ্যালয়ে হাজার হাজার মূক-বধির শিশু শিক্ষা নিয়ে স্বাবলম্বী হলেও সরকারের নজর পড়েনি এখনো। তৎকালীন এমএলএ সুরেষ চন্দ  আগোড়াল প্রতিবন্ধীদের কথা চিন্তা করে পৌরসভার নিকট থেকে ৫ বিঘা জমি কিনে বিদ্যালয়টিকে দান করেন। পরবর্তীতে ওই এলাকার ডা. ইয়াসিন আলীসহ কয়েকজন ব্যক্তি আরও ৯ বিঘা জমি কিনে নেন বিদ্যালয়টির নামে। যেখানে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, স্কুল মাঠ, শিক্ষকদের আবাসিক ভবন এবং সামনের অংশে সড়কের পাশে মূক-বধির নামে একটি বাজার রয়েছে। এই বাজারই মূক-বধির বিদ্যালয়ের একমাত্র আয়ের উৎস। এ ছাড়া স্কুল ভবনের পূর্ব অংশ ভাড়া থেকেও পাওয়া যায় কিছু টাকা। এ দিয়েই কোনো মতে চলছে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের থাকা-খাওয়াসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন।

অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় আবাসনের অভাবে ১৯৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭৪ জন থাকছে আবাসিক ব্যবস্থায়। নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। একটি দ্বিতল এল কাটিং ভবন থাকলেও পূর্বের অংশ নামমাত্র ভাড়ায় একটি প্রতিষ্ঠান দখলে রেখেছে। বিদ্যালয়ে রয়েছে ১০ জন শিক্ষক ও ১২ জন কর্মচরী। বিদ্যালয়ের নেই কোনো নিজস্ব গাড়ির সুবিধা। আর এ কারণে অনেক মূক-বধির প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে দক্ষিণে বনানী বাইপাস মোড়ে যেতে কলোনি এলাকায় সড়কের পূবপাশেই মূক-বধির স্কুল। শিক্ষককে সেখানে ইশারা ইঙ্গিতে ক্লাস নিতে দেখা গেছে। বিদ্যালয়ের উত্তর-পূর্ব পাশে এল কাটিং দ্বিতল ভবনের নিচতলার পশ্চিমাংশে ৬টি শ্রেণি কক্ষ রয়েছে। এসব শ্রেণি কক্ষগুলো খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। একই চিত্র শিক্ষকদের অফিস কক্ষগুলোতেও। আর এই ভবনের দোতলায়ই রয়েছে আবাসন ব্যবস্থা। সেখানেও পরিপাটি অবস্থা দেখা গেছে। পূবপাশে প্রধান শিক্ষকের থাকার একটি কক্ষ রয়েছে। মাঠের দক্ষিণে শিক্ষকদের আবাসনের জন্য তিন তলা বিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। এ সময় শিক্ষকরা বলেন, অসহায় এসব ছাত্রছাত্রী কথা বলতে ও শুনতে না পারলেও এরা খুবই শান্ত। কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়া করে না। যদিও পড়াশোনা করাতে একটু বেগ পেতে হয়। এদিকে জানা গেছে, বিশেষায়িত এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে অসহায় এসব মূক-বধির প্রতিবন্ধী সমাজে স্বাবলম্বী হতে প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষা। কিন্তু কারিগরি বোর্ডে দুই ট্রেডে অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়েও সরঞ্জামাদির অভাবে তা ভেস্তে যাওয়ার পথে। প্রয়োজন ৩০টি কম্পিউটার ও ৩০ সেলাই মেশিন। বগুড়া মূক-বধির বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আতাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের প্রাচীন এই বিদ্যালয়টি উত্তরাঞ্চলের মূক-বধির শিশুদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। তারপরও প্রতিষ্ঠানটি সরকারি করা হচ্ছে না। এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আমরা অনেক কষ্টে সমাজের অন্য সাধারণ মানুষের মতো গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে আমরা পেরেছিও। আমার ও পুরো উত্তরাঞ্চলের প্রাণের দাবি বিদ্যালয়টি যেন সরকার জাতীয়করণ করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর