শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গভীর সমুদ্রে এক দিনের দুঃসাহসিক অভিযান

জয়শ্রী ভাদুড়ী

গভীর সমুদ্রে এক দিনের দুঃসাহসিক অভিযান

এ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, করভেট, ওভিপি, মাইন সুইপার, প্যাট্রলক্রাফট, মিসাইল বোটসহ ৫০টি যুদ্ধজাহাজ

হালকা কুয়াশার চাদর খুলে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভোরের রক্তিম সূর্য। ঢিমেতালে বয়ে চলা কর্ণফুলী আর উত্তাল বঙ্গোপসাগরের মিলন পথ আলোকিত হয়ে ওঠে আলোর ফোয়ারায়। জাহাজের সাইরেনে ঘুম ভাঙা পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির সকালটি হাজির হয়েছিল সমুদ্র অভিযানের বার্তা নিয়ে। বেলা বাড়তেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পোতাশ্রয়ে। 

নীল সমুদ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ (বানৌজা) ‘বঙ্গবন্ধু’। সবুজ সংকেত পেয়েই বঙ্গোপসাগরের বুক চিড়ে বাতাস ফুঁড়ে চলতে শুরু করল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ‘বঙ্গবন্ধু’। বাতাসের তোড়ে কমতে শুরু করে সূর্যের তেজ। সমুদ্রের হিমশীতল বাতাস জানান দিয়ে যায় সমুদ্রের গভীরতা। আস্তে আস্তে দুই চোখের সীমানা থেকে আড়াল হয় স্থলভাগ। চারপাশে শুধু বিপুল জলরাশি আর সমুদ্রের গর্জন। সবাই জাহাজের ডেকে খোশগল্পে ব্যস্ত। হঠাৎ কানে ভেসে আসল গুলির শব্দ। একটা না ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে আসছে গুলি। পাল্টা জবাব দিয়ে শত্রুপক্ষকে আঘাত হানছে দামাল যোদ্ধারা। গণচীন থেকে নিয়ে আসা এসএসএম গুলি নির্ভুলভাবে আঘাত হানল ৩৮ কিলোমিটার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুকে। বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। গ্রিন ল্যান্ড আর ওরেঞ্জ ল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা চলত সবসময়। গ্রিনল্যান্ড আইন অনুযায়ী অর্জিত সমুদ্রসীমায় বিশাল তেল ও গ্যাসের সন্ধান পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ওরেঞ্জ ল্যান্ড। জাতিগোষ্ঠী রক্ষার অজুহাতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে তারা। শত্রুপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে বানৌজা ‘দুর্জয়’ থেকে সি-৭০৪ সার্ফেস টু সার্ফেস মিসাইল উেক্ষপণ করে গ্রিনল্যান্ড। সঠিক নিশানায় ভেদ করে উড়ায় বিজয় নিশান। এরপর বানৌজা ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে উেক্ষপণ করা হয় কিউ ডব্লিউ-২ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। ছয় কিলোমিটার দূরের নিশানায় আলো জ্বলে উঠলে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করে দূরপাল্লার এই মিসাইল। একের পর এক লক্ষ্যভেদী অভিযানে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে শত্রু পক্ষ। তাদের সমুদ্র শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে এবার ছুড়ে দেওয়া হয় সাবমেরিন বিধ্বংসী রকেট ডেপথ চার্জ। জয় পেতে মরিয়া হয়ে ওঠা শত্রু পক্ষ ওরেঞ্জ ল্যান্ড এবার দখল করে নেয় গ্রিনল্যান্ডের একটি যুদ্ধজাহাজ। জাহাজ শত্রু মুক্ত করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রিনল্যান্ডের যোদ্ধারা। দ্রুতগতির ছয়টি স্পিড বোর্ডে চেপে ঘিরে নেয় আক্রান্ত জাহাজ। অপারেশন সফল করতে যুক্ত হয় হেলিকপ্টার। মুহুর্মুহু গুলিতে প্রকম্পিত হয় আকাশ-বাতাস। এক সময় আক্রান্ত জাহাজে প্রবেশ করে গ্রিনল্যান্ডের সৈনিকরা। সুনিপুণ রণকৌশলে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় শত্রু পক্ষ। জ্বলে ওঠে জয়ের শিখা। যুদ্ধ শুনলেই রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গিয়ে শরীরে তৈরি হয় শিহরণ। তাও যদি হয় অথৈ সমুদ্রে তাহলে পারদ মিটারে তা সর্বোচ্চ হতে বাধ্য। এতক্ষণ যে যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছিলাম সেই যুদ্ধ সত্যি হলেও শত্রু ছিল কাল্পনিক। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দেশের সমুদ্রসীমাকে শত্রুমুক্ত রেখে সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে প্রতিবছরই মহড়ার আয়োজন করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। দীর্ঘ ১৮ দিনব্যাপী এই মহড়ার সমাপনী ঘটে গত ৩১ জানুয়ারি গভীর সমুদ্রে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে। এ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, করভেট, ওভিপি, মাইন সুইপার, প্যাট্রলক্রাফট, মিসাইল বোটসহ ৫০টি যুদ্ধজাহাজ। এ ছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে গঠিত বিশেষ নৌ কমান্ডো দল সোয়াডস, নেভাল এভিয়েমনের মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট ও হেলিকপ্টার অংশগ্রহণ করে। নিজেদের সৈনিকদের গ্রিনল্যান্ড আর ওরেঞ্জ ল্যান্ডে ভাগ করে কাল্পনিক শত্রুতায় শুরু হয় মহড়া। সমুদ্রের অফুরন্ত সম্পদকে সুরক্ষিত করতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। আধুনিক সমরাস্ত্র এবং রণকৌশলে এই বাহিনী অর্জন করেছে অনন্যতা। মহড়ায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। মহড়ার শেষে প্রধান অতিথিকে অভিবাদন জানিয়ে বানৌজা ‘বঙ্গবন্ধু’ অতিক্রম করে ফ্লিট রিভিউতে অংশগ্রহণকারী জাহাজগুলো। বাংলাদেশ নৌবাহিনী চিরজীবী হোক ধ্বনিতে হিল্লোল ওঠে সমুদ্রে। সমুদ্রের গর্জনকে অতিক্রম করে ভেসে আসে নৌাহিনীর জয়ধ্বনি বার্তা। আস্তে আস্তে সাগরকন্যার বুকে হেলে পড়ে সূর্য। দৃষ্টি সীমানা থমকে যায় পোতাশ্রয়ে। নোঙরের টানে শেষ হয় এক দিনের সেই দুঃসাহসিক অভিযান।

সর্বশেষ খবর