শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
৯৩ দেশ পাড়ি

বিশ্বজয়ী নাজমুন

তানিয়া তুষ্টি

বিশ্বজয়ী নাজমুন

‘মনের উদ্দামতা আর শরীরের শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের নারীরাও গোটা পৃথিবীকে মাড়িয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ আমি নিজেই। সমুদ্র থেকে সমুদ্রে, পাহাড় থেকে পাহাড়ে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, পৃথিবীর ইতিহাসকে বাস্তব চোখে দেখা- আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ।’

 

মানুষের জীবনকাল খুবই অল্প সময়ের। বিধাতার কাছ থেকে পাওয়া এই জীবন আশীর্বাদস্বরূপ পেয়েছি। যে পৃথিবীতে আমি জন্মেছি সেটি দেখতে কেমন, ভিন্ন গোলার্ধের মানুষগুলো কেমন, তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি কেমন, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের প্রকৃতিকে বিধাতা কীভাবে সাজিয়েছেন তা দেখার এবং অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকেই। বাবার কাছে দেশ-বিদেশের ভ্রমণ কাহিনী শুনতাম। দাদা আলহাজ ফকীহ মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহও একজন ভ্রমণপিয়াসু মানুষ ছিলেন। ভ্রমণের শখটা বলতে পারেন পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছি— কথাগুলো বলছিলেন সম্প্রতি বিশ্বের ৯৩টি দেশ পাড়ি দেওয়া লক্ষ্মীপুরের মেয়ে নাজমুন নাহার। ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া নাজমুন নাহারের বাবা মোহাম্মদ আমিন একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। মা তাহেরা আমিন গৃহিণী। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পড়াশোনার পাশাপাশি নাজমুনের বাবা-ই মেয়েকে বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষামূলক অ্যাক্টিভিটিসের সঙ্গে জড়িত থাকতে বলতেন।

ছোটবেলা থেকে নাজমুনের প্রিয় শখ বই পড়া। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশ বিদেশে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’, এরিক উইনারের ‘দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস’ সুজানা রবার্টসের ‘অলমোস্ট সাম হোয়ার’, চেরিল স্টেরয়েডের ‘ওয়াইল্ড : ফ্রম লস্ট টু ফাউন্ড’ অন দ্য প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইল’ এবং মাসুদ রানা সমগ্র বইগুলো ও বিভিন্ন ট্রাভেল ব্লগার্সদের ব্লগগুলো তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছে।

২০০০ সালে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ হিসেবে ইন্ডিয়ার পাঁচমারীতে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে যোগ দেন। বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পৃথিবীর ৮০টি দেশের গার্লস গাইড এবং স্কাউটদের সঙ্গে। এরপর ২০০৬ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পান। সুযোগ মেলে যায় বিশ্ব ভ্রমণেরও।

পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে টাকা জমাতে থাকেন নাজমুন। কাজের মাঝে যখনই সময় পেতেন কোনো এক শহরে চলে যেতেন। কখনো একা, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ হতো। একা ভ্রমণ করলেও কখনো নিজেকে একা মনে করতেন না। কোনো দেশে গেলে সব সময় ট্রাভেলার্স ইয়ুথ হোস্টেলে থাকতেন। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্রাভেলার্সদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে নিতেন সহজেই। পৃথিবীর প্রকৃতিকে যেমন জানতেন, তেমন ভিন্ন দেশ থেকে আশা মানুষগুলোকেও জানতেন। তাদের সঙ্গে পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চার, সমুদ্রে ভ্রমণ, এক শহর থেকে আরেক শহরে যাত্রা হতো। এভাবেই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে তার ভালো বন্ধু হয়ে যায়। নাজমুন নাহারের ভাষ্য মতে, বেশির ভাগ সময়ই আমি একা ভ্রমণ করেছি এই জন্য যে- পথে হারিয়ে গিয়ে যেন নতুন পথের সন্ধান পাই, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। এভাবেই এশিয়া, ওশেনিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, নর্থ আফ্রিকা, আরবের বিভিন্ন দেশের জিওগ্রাফি, ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি জেনেছেন। ২০১১-২০১৭ সালে মাকে নিয়েও ঘুরেছেন পৃথিবীর ১৪টি দেশে। বাইরোডে ঘুরতেই তার বেশি স্বাছন্দ্য। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে অনেক কিছু দেখার সুযোগ থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশেগুলোর দক্ষিণ প্যাসিফিক থেকে আটলান্টিক সমুদ্রের পাশ দিয়ে ঘেঁষে যাওয়া প্রতিটি শহরে ৩৪০ ঘণ্টা বাইরোডে ভ্রমণ করেছেন। এ ছাড়াও পূর্ব  যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি দেশ এবং ইউরোপের অনেক দেশেই বাইরোডে ভ্রমণ করেছেন।

সেন্ট্রাল এশিয়ার এবং আফ্রিকার বাকি দেশগুলো ২০১৮ সালের মধ্যে ভ্রমণ করবেন। এর মাধ্যমে ১০০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ হবে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের নারীশক্তির অভিষেক ঘটাতে চান বিশ্ব দরবারে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহাদেশে পদযাত্রার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে তিনি বই-ও লিখছেন। তৈরি করেছেন অনেক ডকুমেন্টারি। চালু করছেন ‘ইন্সপেরেশন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রজেক্ট।

প্রজেক্টের মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশের অনাথ শিশু, স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করবেন। পৃথিবীর আলোয় আলোকিত করার জন্য বিশ্ব ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। নাজমুন শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছেন ট্রাভেল ইউটিউব চ্যানেল ‘নাজমুন দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সপ্লোরার’। যেখানে থাকবে তার বিশ্ব ভ্রমণের ওপর বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, ট্রাভেল এপিসোড, ট্রাভেল স্টোরিজ ও ট্রাভেলবিষয়ক শর্টফিল্ম। তার অর্জিত অর্থের অর্ধেক অংশ ব্যয় হবে অনাথ বাচ্চাদের পড়াশোনার উদ্দেশে।

ভ্রমণের এক-দুই মাস আগে থেকেই প্লেনের টিকিট কেটে রাখেন। বাইরোডে গেলে ম্যাপ দেখে গন্তব্যের শহর ঠিক করেন। তবে কোথায় থাকবেন তার প্ল্যান করেন না। সেখানে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে নিলে তার জন্য কম পেমেন্টে সব সমাধান হয় বলে জানালেন। যে দেশে যান তার ওপর পড়াশোনা করতে হয়। ট্রাভেল ব্লগগুলো দেখেন। ব্যাকপ্যাক, মেডিসিন, ডায়েরি, কলম, হাইকিং কেডস, ঠাণ্ডা ওয়েদারে জ্যাকেট, গরমে পাতলা জামাকাপড়, শুকনো খাবার, পানি, মেডিসিন, সেলফি স্টিক, ক্যামেরা, মোবাইল, হ্যাট, একটা বই, সানক্রিম, লোশন, সানগ্লাস, ছোট টর্চলাইট সঙ্গে থাকে। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় তিনি পোস্টকার্ড, সুভিনিউর আর মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এক সময় সবকিছু একসঙ্গে করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার ইচ্ছা আছে।

হৃদয়ে বাংলাদেশ নিয়ে নাজমুন নাহার দুই চোখে দেখবেন এই বিশ্বকে। সাউথ আফ্রিকা আর বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে উদযাপন করতে চান ১০০তম দেশ ভ্রমণের যাত্রা। এই বছরে তিনি বাংলাদেশের সবকটি জেলায় পা রাখতে চান। প্রতিটি জেলার উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় স্থানে গিয়ে ভিডিও ধারণ করবেন। সেখানকার স্কুলগুলোতে ভিজিট করবেন। কথা বলবেন বাচ্চাদের সঙ্গে। বানাবেন ডকুমেন্টারি, যা পরবর্তী দেশগুলোতে প্রদর্শন করা হবে।

সর্বশেষ খবর