শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
অর্জন

বাংলাদেশের প্রথম নারী সার্ফার

সাইফ ইমন

বাংলাদেশের প্রথম নারী সার্ফার

গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় নারীদের বহু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এমন সমাজব্যবস্থায় বড় হয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বহু প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে গেছেন দুরন্ত এক নারী নাসিমা আক্তার। তিনি বাংলাদেশের একজন সার্ফার। যিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম নারী সার্ফার। বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকেই। বন্ধুত্ব হয়েছে সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে। সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গৌরবের পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়েছেন। নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে নিয়মিত। হতে হয়েছে সামাজিকভাবে নানা অন্যায় অপবাদের শিকার। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনি।

ব্রিটেনভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’ ‘বাংলাদেশি সার্ফার গার্ল সিঙ্কস মুসলিম ট্যাবুজ’ শিরোনামে বাংলাদেশি এই তরুণীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উঠে এসেছে নাসিমা আক্তার নামে সংগ্রামী ওই কিশোরীর অসামান্য গৌরবগাথার গল্প। আমাদের দেশে যেখানে পুরুষরাই সার্ফিং করতে সাহস পায় না। আর সেখানে নাসিমা হয়ে উঠেছে একজন দক্ষ নারী সার্ফার। বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ তার নিত্যদিনের সঙ্গী। ভাব জমিয়েছেন সমুদ্রের সঙ্গে আর সুর মিলিয়েছেন অবিরাম বাতাসের পানে। তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।

 

বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত একটি। এখানেই বর্তমানে নাসিমা আক্তার বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে অন্য তরুণীদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন। তাদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ দিয়ে আগ্রহী করে তুলছেন সবাইকে। বাংলাদেশে

 

অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সার্ফিং প্রতিযোগিতায় নাসিমা নিয়মিত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

 

নাসিমার কাছে প্রতিনিয়ত হেরে চলেছেন একের পর এক পুরুষ সার্ফার প্রতিযোগী। সমাজ কি বলবে সেই ভয়ে অনেক মেয়ে যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সার্ফিংয়ে আসত না তারাও আজ নাসিমা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। মার্কিন সাংবাদিক জায়মাল ইয়োগিস খুঁজে পান নাসিমাকে কক্সবাজার এসে। একটি ভ্রমণ বিষয়ক ম্যাগাজিনে ইয়োগিস নাসিমার ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। নাসিমার সঙ্গে ইয়োগিসের পরিচয় চার বছর আগে। তিনি বলছিলেন, নাসিমা তাদের বাইরে বেরিয়ে তাদের পছন্দের কাজ করার সাহস জুগিয়েছে। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ার এক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিদার কেসিঞ্জার বড় পর্দায় নাসিমার গল্পটি তুলে ধরতে চাইলেন। নিকি তার ভিন্ন চোখ দিয়ে নাসিমাকে তুলে ধরলেন সেলুলয়েড পর্দায়। তিনি তৈরি করেন তার নতুন প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’। এ ডকুমেন্টারিতেই উঠে এসেছে নাসিমার অসামান্য এগিয়ে চলার গল্প। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নাসিমা। যোগ দেয় একটি সার্ফিং ক্লাবে। এখানে এসে জীবনকে নতুনভাবে শুরু করে নাসিমা। হন দেশের প্রথম নারী সার্ফার। এই কাহিনীই উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্র দ্য মোস্ট ফিয়ারলেসে। নাসিমাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের নামকরণ ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ করার কারণ ব্যাখ্যা করলেন পরিচালক। ইয়োগিস বললেন, ‘তার মধ্যে যেমন ছিল চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য, পাশাপাশি ছিল দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত আমরা চলচ্চিত্রের নাম ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ রাখলাম। এদিকে নাসিমা সার্ফিংয়ে যত উন্নতি করতে লাগল, তার পুরস্কারের অর্থও সমানতালে বাড়তে লাগল। তারপরও শুধু সেই অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা নানা ধরনের মনোহর বস্তু ও শামুক-ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করত এবং কখনো কখনো উল্টো করে শুইয়ে রাখা নৌকার তলায় ঘুমাতো। প্রামাণ্যচিত্রটিতে সালোয়ার-কামিজ ও ঊরুসমান শার্ট পরিহিতা নাসিমাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

নাসিমা আক্তার শুধু বাংলাদেশে নারীদের সার্ফিংয়ের সূচনার পথিকৃৎ নন, তিনি কক্সবাজারের লাইফসেইভিং অ্যান্ড সার্ফিং ক্লাবে বাংলাদেশের প্রথম নারী লাইফগার্ড বা প্রাণ রক্ষাকারী ব্যক্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সার্ফ ক্লাবের সদস্য নাসিমার সঙ্গে এখন আরও নারী সার্ফার রয়েছেন। নাসিমাই এখন তাদের পথ দেখাচ্ছেন। সবারই নাসিমার মত প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। নাসিমাও যেমন মানুষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন তেমনি সবাইকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। আশপাশের লোকজনরা মেয়ে সার্ফারদের নানা কথা বলে বিদ্রূপ করেছে। কিন্তু নাসিমার মতো আর সবাই স্বপ্ন দেখছে লক্ষ পূরণের। তাই কোনো কিছুই আর বাধা হয়ে পড়ছে না তাদের জন্য। আর দলটিকেই সামনে

 

থেকে মশাল হাতে পথ দেখাচ্ছেন নাসিমা। বাংলাদেশ এখনো সার্ফিংয়ে একেবারেই নতুন। অথচ দেশে বর্তমানে নারী সার্ফারের সংখ্যা পুরুষ সার্ফারদের তুলনায় বেশি। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে নারীর চেয়ে পুরুষ সার্ফারের সংখ্যা বেশি। এত অর্জন আর সাফল্য সত্ত্বেও, সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে নাসিমাকে। সমাজের মানুষ এখনো বিষয়টাকে মোটেও ভালো চোখে দেখছে না বলে জানান নাসিমা। কিন্তু একটি মোবাইল প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন নাসিমা। সেই মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে স্থান করে নেওয়াটা সমাজের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন অনেকে।

চিত্রপরিচালক কেসিঞ্জার বলেন, ‘জীবনে বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়েও নাসিমা হাল ছাড়তে আগ্রহী নন এবং তিনি অন্য মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো স্থানের পথিকৃেদর কথা ভাবুন। কখনো কখনো তারা নিজের কাজের স্বীকৃতি পান এবং সমাজ তাদের বুঝতে পারে, কখনো হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের চিনতে পারে। নাসিমার গল্প এখনো শেষ হয়নি।’

সর্বশেষ খবর