শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিস্ময়

আরেক পৃথিবী

‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’

শনিবারের সকাল

আরেক পৃথিবী

— ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’-এর ভর পৃথিবী থেকে সামান্য বেশি, পৃথিবীর মতোই পাথুরে

সৌরমণ্ডলের হ্যাবিটেবল জোনে তিনটি গ্রহ রয়েছে। শুক্র, পৃথিবী আর মঙ্গল। শুক্র গ্রহটি হ্যাবিটেবল জোনের অনেকটাই ভিতরে এবং মঙ্গল ওই জোনের বাইরের দিকে। পৃথিবীটাই রয়েছে হ্যাবিটেবল জোনের ঠিক জায়গায়। নতুন আবিষ্কৃত এই ভিনগ্রহটিও রয়েছে তার নক্ষত্রের হ্যাবিটেবল জোনে।

গ্রহটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’ ও পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আলফা সেনটাওরি সৌরজগতের পাথুরে গ্রহ। প্রক্সিমা সেনটাওরি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা অনেকটাই পৃথিবীর মতো এ গ্রহটি সৌরজগৎ থেকে মাত্র ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা গ্রহটি নিয়ে আশায় বুকও বেঁধেছেন এবং গ্রহটিকে তারা ‘পাশের প্রতিবেশী’ বলে দাবি করছেন।

 

ভরের দিক থেকেও ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি বি’ পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এবং অনেকটাই পৃথিবীর মতো দেখতে। গ্রহটি সৌরমণ্ডলে যাকে ঘিরে পাক মারছে, সেই নক্ষত্র প্রক্সিমা সেনটাওরি আমাদের সূর্যের তাপের মতো অতটা প্রস্ফুটিত নয়। বরং তা অনেকটাই নিভু নিভু আঁচের উনুন। আমাদের সূর্যের মতো সেই ‘উনুনে’র চেহারাটাও নয় খুব বড় মাপের। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় বামন আকৃতির এই নক্ষত্রটিকে ‘রেড ডোয়ার্ফ স্টার’ কিংবা লাল বামন নক্ষত্র বলা হয়। ফলে, একে পদক্ষিণ করতে গিয়ে সদ্য আবিষ্কৃত ভিন গ্রহটির পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

 

পানি যেহেতু জীবনের অন্য নাম, তাই এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও প্রাণ খোঁজার যাত্রাপথে প্রথম স্টপেজটা হতে চলেছে এই প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি গ্রহটি। মহাকাশের এই মুল্লুকে প্রাণ খুঁজতে প্রথমেই এই ভিন গ্রহে থামতে হবে। কারণ, গ্রহটি আমাদের সবচেয়ে কাছে। যার মানে, সর্বাধুনিক মহাকাশযানের গতিবেগ যা, তাতে আজ যাত্রা শুরু করলে তা প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি ভিন গ্রহে পৌঁছবে ৭০ হাজার বছর পর। তবে আগামী দিনে মহাকাশযান চলবে লেজার রশ্মির তেজে। ফলে তা হয়ে যাবে অনেক দ্রুত গতির। তাই প্রাণের

সন্ধানে করা অভিযান শুরু করতে প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি গ্রহে পৌঁছান হবে সহজ।’

 

গ্রহটি মোটামুটি পৃথিবী  থেকে ২৫ প্রিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত। এর ভর পৃথিবীর ভরের থেকে ৩০% বেশি। পৃথিবীর মাত্র ১১ দিন সময়ে গ্রহটি তার নক্ষত্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসে, পৃথিবীর ১১ দিনে সেখানে এক বছর হয়। ১৯৯২ সালে সৌরজগতের বাইরে প্রথম কোনো গ্রহ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। মাঝে কেটে গেছে বছর, এর মধ্যে কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তিন হাজারেরও বেশি ভিন গ্রহের দেখা মিলেছে। তবে কোনো গ্রহ প্রাণবান্ধব অঞ্চলের সন্ধান মিলল এই প্রথম।

যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে গ্রহটি ঘোরে তার ভর সূর্যের ভরের মাত্র ১২%। ভর কম হওয়াতে এর হ্যাবিটেবল জোন নক্ষত্রের অনেক কাছ থেকেই শুরু হয়। গ্রহটিতে যদি বায়ুমণ্ডল থাকে তাহলে এর তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হবে যেটি ওই গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনাকে দৃঢ় করে।

 

কোনো গ্রহে প্রাণ সৃষ্টির জন্য বায়ুমণ্ডল থাকাটা খুব জরুরি। প্রক্সিমা সেনটাওরি বি গ্রহে বায়ুমণ্ডল আছে কিনা বা তা কোনো কালে ছিল কিনা, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কথায়, ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি গ্রহে বায়ুমণ্ডল রয়েছে কি না বা তা কোনো কালে ছিল কি না সেখানে, সে ব্যাপারে এখনো কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তা ছাড়াও চাঁদের একটা পিঠই যেমন পৃথিবীর সামনে থাকে সব সময়, অন্য পিঠটি কোনো দিনই পৃথিবীর মুখ দেখতে পারে না, তেমনই ভিন গ্রহটিরও একটা পিঠ সব সময়েই থাকে তার নক্ষত্র প্রক্সিমা সেনটাওরির সামনে। অন্য দিকটিতে নক্ষত্রের আলো বা তাপ সে ক্ষেত্রে পৌঁছতেই পারে না, কস্মিনকালে। তার ফলে, ওই গ্রহের যে দিকটা তার নক্ষত্রের সামনে রয়েছে, তার ওপর অনবরত এসে আছড়ে পড়ে সৌরঝড়, মহাজাগতিক রশ্মি, নানা রকমের বিকিরণ। তা প্রাণ সৃষ্টির পথে বাধা হবে। তবুও যদি প্রাণ থেকে থাকে তা হলেও সেই প্রাণের বিকাশ কিছুতেই সম্ভব নয় নানা রকম সৌরঝড়ের দৌলতে।’

এখানে দিন-রাত বা আহ্নিক গতি বলে কিছু নেই। যে অক্ষে এটি তার নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে তা পুরোপুরি গোলাকার হওয়ায় এখানে কোনো ঋতুও নেই। পৃথিবীর দুই মেরুকে নানা সৌরঝড়ের মোকাবিলা করতে হয়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হওয়ায় তা বিপজ্জনক কণাগুলিকে পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। এ ধরনের প্রতিরক্ষা আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

সম্প্রতি নাসা নতুন একটি মহাকাশযান তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন যার মাধ্যমে মাত্র ২০ বছরেই প্রাণের সন্ধানে পৌঁছে যাওয়া যাবে এ গ্রহে।  লেজারের মাধ্যমে একে আলোর ২০% গতিতে ত্বরান্বিত করা সম্ভব (ঘণ্টায় ১৩৪.১২ মিলিয়ন মাইল)। এই গতিতে চললে প্রোবটি ২০-২৫ বছরেই পৌঁছে যাবে প্রক্সিমা সেনটাওরি বি  তে। সেখান থেকে পৃথিবীতে সিগনাল আসতে সময় লাগবে ৪.৩ বছর। এ প্রজেক্টটির পেছনে খরচ হবে ১০ বিলিয়ন ডলার। মহাকাশযানটি তৈরিতে লেগে যাবে ২০-৩০ বছরের মতো। অর্থাৎ সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির প্রোবটিও প্রস্তুত হতে ও গ্রহটিতে পৌঁছতে মোট সময় লাগবে ৫৫ বছরের মতো অর্থাৎ প্রায় ২০৭০ সাল।

 

কী আছে ওখানে? কল্পনা করতে ভালো লাগছিল যে হয়তো মিটমিট করে জ্বলতে থাকা ঐ তারকারাজির মধ্যেই কোনো একটি গ্রহে বসে কেউ একজন আমাদের সূর্যের দিকে তাকিয়েও ঠিক এভাবেই শিহরিত হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর