শিরোনাম
শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
অনুরাগ বসু

ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার থেকে সফল চিত্র পরিচালক

সাইফ ইমন

ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার থেকে সফল চিত্র পরিচালক

অনুরাগ বসু হলেন একজন ভারতীয় টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্মাতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন ২০০৩ সালে ‘কুচ তো হ্যায়’ দিয়ে। বসু মূলত তার চলচ্চিত্রে কামনা  ও পরকীয়া বিষয়ক গল্প উপস্থাপনার মাধ্যমে আলোচিত হন

 

মানুষের জীবটাই এক একটি নাট্যমঞ্চ আর অভিনেতা হলেন মানুষ। আর এই মঞ্চে একটি সুখের দৃশ্যের পরই চলে একটি দুঃখের দৃশ্য। তেমনি একটি দুঃখের দৃশ্যের পরই চলে একটি সুখের দৃশ্য। সুখ-দুঃখের কাঁচাঘরে বড় হওয়া অভিনেতা বলিউড পরিচালক অনুরাগ বসু। জীবনের দোল খেলায় নানা উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়ে সফলদের কাতারে দাঁড়ান। তার জীবনের কাহিনীও এক সিনেমার মতো।  

ছত্তিসগড়ের ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে আধিপত্য বিস্তার খুব সহজ কাজ নয়। অনুরাগ বসুর ছেলেবেলা কাটে ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ের বাঙালি পরিবারে। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছত্তিসগড় ছিল বেশ সমৃদ্ধশালী। আর তাই তো নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করেন তিনি। তবে সেকেলে জীবনে উন্নতির সিঁড়ি বলতেই মানুষ বুঝতো পড়ালেখা। এর বাইরেও যে কোনো জগৎ থাকতে পারে তা ছত্তিসগড়ের মানুষের কাছে ছিল অজানা। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাকেও পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন।

অনুরাগ বসু শুধুমাত্র বই-পুস্তকের পাতায় আবদ্ধ ছিলেন না। পৃথিবীকে জানতে আর সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে লালন করতে তিনি ছেলেবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক চর্চা করতেন। স্কুলের আয়োজনে সবার আগে তার নামটাই থাকতো। রম্যরসে গল্প বলতে পারার জন্য তিনি স্কুলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। নিজের এই অসামান্য দক্ষতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছাটাও ততদিনে মন থেকে মুছে যায়।

স্ট্যান্ডার্ড ১২ পাসের পরই তিনি বাবা-মাকে জানিয়ে দেন, ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, তিনি হতে চান পরিচালক। বাবা-মা তার কথায় রাজিও হন। ফলত তাকে পরিবারকে রাজি করানো নিয়ে বেগ পেতে হয়নি। ১৯৯৬ সালে পা রাখেন স্বপ্নের শহর বোম্বেতে। লক্ষ্য অনেক দূর তা বুঝতে পেরে কঠিন সংকল্প করেন তিনি। তিনি চেয়েছিলেন একজন পরিচালক হতে, কিন্তু তার তো অভিনয়ের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না।

স্বপ্নপূরণে মরিয়া অনুরাগ অনেক লোকের পিছু ছোটেন। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই তার সঙ্গে প্রতারণা করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো বড় স্বপ্নই রাতারাতি সত্যি হয় না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বরং নিজের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে চললেন সেই পথ ধরে। একজন পরিচালক হওয়ার আগে পরিচালকের সেটে কাজ করেন। প্রবেশ করেন বলিউড ফিল্ম ইন্ড্রাস্টিতে। শুরুটা করলেন একদমই নগণ্য কোনো কাজের মাধ্যমে। একজন ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার হিসেবে! আর তারপর মেকআপ আর্টিস্টের সহযোগী হন। শুধু এই কাজগুলোতেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং এসব কাজের মাধ্যমে অনেক নামজাঁদা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। এবং যথাসাধ্য নামজাদাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

অনুরাগ বেশ ভাগ্যবান ছিলেন, কারণ যে সময়টায় তিনি পরিচালক হওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সে সময়টাই   ভারতবর্ষজুড়ে স্যাটেলাইট চ্যানেলের নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। নতুন নতুন চ্যানেল চালু হওয়ায় তখন সৃজনশীল ব্যক্তিদের অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। তখন অনুরাগ ‘তারা’ চ্যানেলে একজন সহযোগী পরিচালকের কাজ পেয়ে যান। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। পর পর অনেক অনুষ্ঠানের পরিচালনা করেন, কিন্তু সবই টিভির জন্য।

এভাবে নিজের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছিল না। কেননা, তিনি চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের পরিচালক হতে। তাই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার সুযোগ। ঠিক তখনই পরিচালক ও প্রযোজক মহেশ ভাট তাকে একটি প্রস্তাব দেন। সিনেমাটির নাম ছিল ‘মার্ডার’। এই সিনেমা পরিচালনার কাজ পান অনুরাগ বসু। শুরু হলো পরিচালক হিসেবে পথচলা।

তার পরিচালিত ‘মার্ডার’ সিনেমাটি দারুণ সাড়া ফেলে এবং বক্স অফিস প্রচুর আয় করে। সবমিলিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অনুরাগের শুরুটা যেন স্বপ্নের মতোই। তখন পর্যন্ত অনুরাগের কাছে মনে হচ্ছিল, তার জীবনটা যেন একদম প্ল্যান অনুযায়ী চলতে শুরু করেছে।

এখান থেকেই তার ক্যারিয়ার ঊর্ধ্বমুখী হয়। ২০০৪ সালে তিনি বিয়ে করেন। এবং শুরুও করেছিলেন পরবর্তী সিনেমার শুটিংয়ের কাজ। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার জীভনে আসে ঝড়। তার শরীরে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে! ক্যান্সারটি দাবানলের মতো তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ৫০ শতাংশ। অনুরাগের বার বার মনে হতো, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যেই বুঝি তার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর আগে তার জীবনে শুধু একটিই চাওয়া ছিল, তা হলো অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যাওয়া। আর সেজন্য তাকে আরও তিনটি মাস যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হতো।

তিন মাস বেঁচে থাকার মনসকামনা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থেকে সন্তানের মুখ দেখার প্রশান্তি পেয়েছিলেন অনুরাগ বসু। এরপর ছোট ছোট পরিকল্পনা করে সেগুলোতে সাফল্য লাভ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখনো তিনি শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। তখন তার মনে হতো, বেঁচে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। তখন তিনি হাসপাতাল ছাড়েন এবং সিনেমা পরিচালনায় পুনরায় মনোনিবেশ শুরু করেন।

কিন্তু শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় কোনো প্রযোজকই তার সঙ্গে কাজ করতে চাইল না। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছোট পর্দায় ফিরে যাবেন। ঠিক তখনই তার হাতে আসে ‘গ্যাংস্টার’ ছবির প্রস্তাব। দেরি করেননি লুফে নেন সুযোগ। ‘গ্যাংস্টার’-এর সাফল্যের পর তিনি শুরু করেন ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ ছবির কাজ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পরই ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা ‘বারফি’ পরিচালনা করেন। যা তাকে পরিণত করেছে বর্তমান সময়ে বলিউডের অন্যতম সফল ও আলোচিত পরিচালককে।

সাফল্য বা ব্যর্থতা তাকে খুব বেশি ভাবায় না। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। বেঁচে থাকার আনন্দকে সঙ্গী করেই নামজাদা এই পরিচালক কাজ করে যেতে চান। কখনো হয়ত সে কাজে সফল হবেন, আবার কখনো ব্যর্থ। কিন্তু তিনি জানেন, এরই নাম জীবন!

 

সর্বশেষ খবর