শিরোনাম
শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কনটেস্টে আমাদের সোহান

তানিয়া তুষ্টি

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কনটেস্টে আমাদের সোহান

সোহানের এই ছবিটি সেরা হওয়ার লড়াইয়ে

প্রথমে ছিল ছোটখাটো শখ। ধীরে ধীরে পরিণত হলো প্যাশনে। হাতেখড়ির গল্প অনেক পুরনো হলেও গুরুত্ব সহকারে কাজ শুরু ২০১২ সাল থেকে। সেই শখ আজ পদার্পণ করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। শখটি আর কিছুই নয়, আবেগ আর ভাবনা জড়িত ফটোগ্রাফি। বলছি বগুড়ার ছেলে মাসফিক সোহানের কথা। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কারে ১২৫টি দেশের মোট ৪ হাজার ৫৪৮ জন আলোকচিত্র-সাংবাদিকের ৭ হাজার ৩৪৪টি ছবি জমা পড়ে কনটেস্টের জন্য। এর মধ্যে সোহানই একমাত্র বাংলাদেশি, যার ‘ওয়াচিং হাউস বার্ন’ ছবিটি একটি বিভাগের সেরা তিনে পৌঁছেছে। ১২ এপ্রিল নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই বড়। খুব দুষ্টু, নাছোড়বান্দা আর জিদ না থাকলে এসব কাজে সফলতা খুব একটা আসে না। সোহানের চরিত্রে এগুলোর কোনোটিরই কমতি ছিল না। বরং যে কোনো কিছুর রিস্ক নেওয়া তার স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সবে পেরিয়েছেন মাধ্যমিকের গণ্ডি। পকেট খরচ জমিয়ে সনির একটি ছোট ক্যামেরা কিনে নিলেন। প্রথম দিকে মা-বাবা, ঘরবাড়ি, প্রতিবেশীদের ছবি তুলতেন। ২০১২ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর হাতে তুলে নিলেন একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই ক্যামেরা নিয়ে ছুট। কখনো রেললাইন, কখনো সার্কাস, কখনো গ্রাম্য ঐতিহ্যবাহী খেলার আসরের ছবি তোলা। এগুলো দিয়ে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির প্রাথমিক পাঠ তার হয়ে যায়।

কখনো একা, কখনো দলের সঙ্গে পরিকল্পনা করে অথবা হঠাৎ করেই চলে যান এখানে সেখানে। কখনো ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও কিছু ক্লিক করে আবার ফিরে আসেন বাসায়। এমন খামখেয়ালি আর দুরন্তপনা তার স্বভাবের নিত্যকার বৈশিষ্ট্য। ২০১২ সালে পঞ্চগড় গিয়ে পেয়ে গেলেন লায়ন সার্কাস দলের দেখা। সেখানে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। জানতে পারে রঙিন সাজে দর্শক মাতানো মানুষের বাস্তবিক জীবনের অনেক কিছুই। মনে কষ্ট রেখে তারা লোক হাসান। তাকে নিয়েই ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি করলেন সোহান। সোহানের করা ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতে উঠে এসেছে অনেক কিছুই— রেললাইনের জীবন, বন্যার্ত মানুষ, রোহিঙ্গাসহ আরও কিছু বিষয়।

শখের এই ফটোগ্রাফির পেছনে খরচাপাতিও কম নয়। প্রথম দিকে পকেট খরচের টাকা বাঁচিয়ে চলা গেলেও পরে আর যেন চলতেই চায় না। পছন্দমতো লেন্স কেনা, ছবির নেশায় এদিক সেদিক ছুটে চলায় টাকার দরকার পড়ে। এমন অবস্থায় ভাবনায় পড়ে যান। তখন কাছের বড়ভাই  আলোকচিত্র-সাংবাদিক রেহমান আসাদের পরামর্শে এজেন্সিতে ছবি দিতে শুরু করেন। ইতালিভিত্তিক নূর ফটো এজেন্সি সোহানের ছবিও পছন্দ করল। সোহানের ছবি তোলা শুরু হলো তাদের জন্য। বর্তমানে তুরস্কের আনাডোলু ফটো এজেন্সির হয়েও কাজ করেন সোহান।

“৯ সেপ্টেম্বর দুপুরের পরপরই হাজির হই লেদা ক্যাম্প টেকনাফ। সেখানে হঠাৎই চোখে পড়ে মানুষজন পাহাড়ের দিকে দৌড়াচ্ছে। তাদের পিছু ছুটে আমিও উঠলাম পাহাড়ের ওপর। দেখতে পেলাম একটি হৃদয় বিদারক চলমান চিত্র। দ্রুত ক্যামেরাবন্দী করে নিতে ভুল হলো না। ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ল, ওই পারে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। আর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গারা তা দেখছিল। তাদের চোখে জল। অনেকে ফোনে ওপারে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলছিল। ছবিতে বন্দী হলো নাফ নদের ওপারে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। শিরোনাম দিয়ে দিলাম ‘ওয়াচিং হাউস বার্ন’। ১০ তারিখে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে সেটি ছাপা হয়। এরপর টাইম ম্যাগাজিনসহ আরও অনেক জায়গায় ছাপা হয়েছিল। অনেকের প্রশংসাও কুড়িয়েছিল ছবিটি”— কনটেস্টে যাওয়া ছবি সম্পর্কে এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন মাসফিক সোহান। সোহান বলেন, ‘সামাজিক নিপীড়নের মুখে এ ধরনের ফটোগ্রাফি আমার এক ধরনের প্রতিবাদ বলতে পারেন। আমি নির্মম শাসকগোষ্ঠীর অপকর্মকে বিশ্বের কাছে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি’।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আয়োজিত বার্ষিক ফটো কনটেস্টে সিলভার ও ব্রোঞ্জ পুরস্কার পান। বিশ্বব্যাংক আয়োজিত দ্য কনসালটেটিভ গ্রুপ টু অ্যাসিস্ট দ্য পুওর বা সিজিএপি শীর্ষক প্রতিযোগিতায় এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড, দ্য হামদান বিন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডস ২০১৬-১৭-এর ফাইনালিস্ট ছিলেন। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক গ্রুপ (বিডিপিজি) আয়োজিত প্রথম ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, হাফিংটন পোস্ট, দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, আল জাজিরাসহ অনেক সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে তার তোলা ছবি।

 

সর্বশেষ খবর