শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বজনের খোঁজে বাংলাদেশে আনোয়ারা

জন্মের পর যুদ্ধশিশু হিসেবে আনোয়ারার আশ্রয় হয় টঙ্গীর একটি শিশু সদনে। সেখান থেকে তাকে দত্তক নেয় নেদারল্যান্ডসের এক শিক্ষক পরিবার। বর্তমানে তিনি ডাচ নাগরিক। পেশায় নার্স। হারানো স্বজনদের খোঁজে সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে...

শেখ মেহেদী হাসান

স্বজনের খোঁজে বাংলাদেশে আনোয়ারা

অক্টোবর ’৭১ থেকে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জন্ম নেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু ও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তালিকা করা হয়নি। তাদের মায়েরা জন্মকালেই নিরুপায় হয়ে সন্তান ত্যাগ করেন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বহু শিশু নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়। যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকেরই আশ্রয় হয় মাতৃসদনে। কোনো কোনো মা সন্তান ফেলতে না পেরে ভিন-জেলায় কিংবা অবৈধ পথ পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আর এসব শিশুকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘বেআইনি শিশু’ বা ‘যুদ্ধশিশু’। সম্ভবত আনোয়ারা তাদের একজন

 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও অবাধ যৌনাচার। ধর্ষিত নারীর গর্ভে বহু শিশুর জন্ম হয়। অক্টোবর ’৭১ থেকে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জন্ম নেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু ও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তালিকা করা হয়নি। তাদের মায়েরা জন্মকালেই নিরুপায় হয়ে সন্তান ত্যাগ করে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বহু শিশুর নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়। যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকেরই আশ্রয় হয় মাতৃসদনে। কোনো কোনো মা সন্তান ফেলতে না পেরে ভিন-জেলায় কিংবা অবৈধ পথ পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর এসব শিশুকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘বেআইনি শিশু’ বা ‘যুদ্ধশিশু’। সম্ভবত আনোয়ারা তাদের একজন। ১৯৭৮ সালে তাকে দত্তক নিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের এক শিক্ষক পরিবার। তার পালক বাবা এভার্ট ডেকার আর মা ম্যারিয়েন রেজনেভেল্ড। নতুন মা-বাবার আশ্রয়ে জীবন বদলে যায় তার। মাতৃসদনের জীবন থেকে একান্ত বাড়ির পরিবেশে বাবা-মায়ের আদরে বড় হন তিনি। আনোয়ারা বলেন, ‘জন্মের পর আমার আশ্রয় হয় টঙ্গীর একটি শিশুসদনে। যতদূর মনে পড়ে সেখানে ৮-১০ জন শিশু মিলে আমরা খেলতাম। মাঝে মাঝে সম্ভবত আমাদের দিয়ে কাজ করানো হতো। আরেকটু স্পষ্ট করলে মনে পড়ে, আমি বাম হাত দিয়ে কী যেন গুঁড়া করতাম। আর ডান হাত দিয়ে কিছু একটা টেনে দিতে হতো আমাকে। আর বিশেষ কিছু মনে পড়ে না।’

নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পর নতুন পরিবেশে আনোয়ারা পেয়েছিল সুন্দর জীবন। সেখানে বেসিক স্কুল পড়াশোনা শেষ করে নার্সিং বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন তিনি। পরে তিনি নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে আনোয়ারা ডাচ নাগরিক। তার বিয়ে হয়েছে টমাস নিউয়ের সঙ্গে। টমাস একজন ব্যাংকার। তাদের দুই সন্তান। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তার। কিন্তু রয়ে গেছে বড় এক শূন্যতা। আনোয়ারা বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে আছিয়া আর মুনা। একজনের বয়স ১০ আরেক জনের ১১। কিন্তু তারা যখন জিজ্ঞেস করে তাদের নানা-নানী কে? আমি উত্তর দিতে পারি না। আমার মন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। আমি জানি না আমার মা-বাবা কে! এই দূর দেশে বসে আমার মন উতলা হয় দেশের জন্য, আমার হারিয়ে যাওয়া স্বজনের জন্য।’

আনোয়ারা নিজের শিকড়ের সন্ধানে ১৯৯২ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু পরিচিত তেমন কেউ না থাকায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হয়নি। টঙ্গী গিয়েও তিনি ছোটবেলার সেই স্থানটি খুঁজে বের করতে পারেননি। এরপর ২০০৫ সালে আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন আনোয়ারা। সে সময়ই কিছু ডাচ্ বন্ধুর সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। আনোয়ারার ডাচ্ বন্ধুদের বাংলাদেশি বন্ধুরা এ বিষয়ে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘সে সময় বাংলাদেশি যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমি চেষ্টা করেছি আমার মা ও স্বজনদের খুঁজে পেতে। বাংলাদেশে আমার পরিচিত নেদারল্যান্ডসের কেউ গেলেই আমি একই কথা বলি। আমার স্বজনদের খুঁজে পাওয়া যায় কি না যাতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবার নিরাশ হয়েছি। আমিও তেরেসা ও মার্থা নামে দুটো মেয়েকে দত্তক নিয়েছি। হয়তো ওদেরও একদিন আমার মতো অবস্থা হবে।’ চলতি বছর জানুয়ারি মাসে তিনি আবার আসেন বাংলাদেশে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, ‘আমার পালিত বাবা মায়ের কাছে দু-একটি কাগজ পেয়েছিলাম। তারা আমাকে টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। মাতৃসদনের রেকর্ড ছিল লালুরকান্দি, আড়াইহাজার। এবার এসে এলাকার চেয়ারম্যান, স্থানীয় মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলেছি। লিফলেট বিলি করেছি। কারও খোঁজ আমি পাইনি। হয়তো আমার মা আর বেঁচে নেই। কিন্তু অন্য কেউ নিশ্চয় বেঁচে আছেন।’

দূর দেশে বসে স্বজনদের কথা ভেবে আনোয়ারার চোখ ছলছল করে ওঠে। আপন জনের জন্য মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। নিরুপায় আনোয়ারা সবার অলক্ষ্যেই সেই চোখের জল আড়াল করেন। মেয়েরা যখন স্বজনদের কথা জিজ্ঞেস করত তখন আনোয়ারা উত্তর দিতে পারতেন না। তখনই তাগিদ অনুভব করেন নিজের মা ও অন্য স্বজনকে খুঁজে বের করতে। সম্প্রতি আনোয়ারার এক বন্ধু বাংলাদেশে আসেন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে। তখন আনোয়ারা তার হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথা বলেন তাকে। সেই বন্ধু নানাভাবে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সে সূত্রে আনোয়ারা এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। তার বর্তমান নাম আনোয়ারা বেগম ডেকার নিউ। তিনি বাংলা বলতে পারেন না। তিনি মনেপ্রাণে হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে খুঁজে পেতে চান। তিনি বাংলাদেশে যোগাযোগের জন্য ০১৮৪৭২৮৮১৯৪ এই নম্বরটি দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর