শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নারী ফুটবলে জাগরণ

রাশেদুর রহমান

নারী ফুটবলে জাগরণ

পেছনের গল্পটা এমন; মেয়েরা খেলবে ফুটবল! ওটা ছেলেদেরই খেলতে দাও। ফিফার বাধ্যবাধকতা আছে তো কী হয়েছে। নামকাওয়াস্তে একটা দল থাকলেই হলো! এখানে সামাজিক বাস্তবতাটা আগে মানতে হয়। তারপর বৈশ্বিক। পাড়ার লোকেরা বলে, মেয়েকে পাঠিয়েছ সবার সামনে ফুটবল খেলতে! ওদেরকে বরং একটা লুডু কিনে দাও। কিছু পুতুল আর হাঁড়ি-পাতিল দিয়ে বসিয়ে দাও। গ্রামের সেই লোকদের কে বুঝাবে, মেয়েরা এখন আর পুতুল-হাঁড়ি-পাতিলে সীমাবদ্ধ নেই। তারা বিশ্ব জয় করতে বেরিয়েছে বহু আগেই। মহাকাশ অভিযানে গেছে। পর্বত ডিঙ্গিয়েছে। জয় করেছে আরও কঠিন সব বাধা। এই যুগ, মেয়েদের প্রভূত অগ্রগতির যুগ। মেয়েরা যে সুযোগ পেলে কী করতে পারে তার প্রমাণ বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। জাতীয় দল তো বটেই, ভিনদেশে বিজয় পতাকা উড়াচ্ছে এবার ছোট ছোট মেয়েরাও। এক সময় মেয়েদের ফুটবল খেলতে দিতে বাবা-মায়ের কাছে রীতিমতো দরখাস্তই দিতে হতো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)। স্কুলের মাস্টারমশাইদের বুঝাতে ঘাম ঝরত। সমাজের লোকদের নিয়ে দিনের পর দিন চলত সেমিনার। বক্তারা ক্লান্ত হয়ে যেতেন মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টায়। এই অবস্থা বদলে যেতে থাকে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই। কাগজে-কলমে ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল শুরু হলেও ২০১০ সালের এসএ গেমসের আগে জাতীয় দলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এসএ গেমসেই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের মেয়েরা।

প্রথম ম্যাচে নেপালের কাছে হারলেও সেই টুর্নামেন্টে দুইটা ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। ওই বছরেরই শেষ দিকে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয় কক্সবাজারে। ভুটান আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতলেও হেরে যায় ভারত ও নেপালের কাছে। জাতীয় দল এরপর ২০১২ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৪ সালের মেয়েদের এশিয়ান কাপ বাছাই পর্ব ইত্যাদিতে অংশ নিয়ে খুব একটা সফল হতে পারেনি। ব্যক্তি হিসেবে সাবিনা খাতুন কৃষ্ণা রানী সরকাররা অনেক দূরে চলে গেছেন। মালদ্বীপ আর ভারতে এখন সাবিনাদের কদর অনেক। জাতীয় দল তেমন একটা সাফল্য না পেলেও ভিন্ন পদক্ষেপে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে অগ্রযাত্রার সেই গল্পটা। মেয়েদের ফুটবল চলছিল গতানুগতিকভাবেই। ২০১১ সালে ভিন্ন এক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জাপানি এনজিও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল মেয়েদের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ট্যালেন্ট হান্ট থেকে উঠে আসে এক ঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার। কিরন বলছিলেন, ‘আমাদের ফান্ড ছিল না। জাপানি এনজিও এগিয়ে আসায় অনেক বড় সুযোগ তৈরি হয়েছিল।

আজকের যে অনূর্ধ্ব-১৬ দলটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা সে সময়কারই তৈরি করা।’ প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ফান্ড শেষ হলেও অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি। বাফুফে ও জাপান ফুটবল ফেডারেশনের সহযোগিতা সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য হয়ে বন্ধুর পথটাও অনেক মসৃণ প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ছাড়াও দলের টেকনিক্যাল কোচ পল স্মলি দিনমান চেষ্টা করছেন। মেয়েদের ফিটনেস বাড়ানো থেকে শুরু করে নানান দিক দিয়ে সাহায্য করছেন পল। এক সময় তিনি ইংল্যান্ডের ইয়ুথ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের ক্ষুদে দলটাকে। এর উপযুক্ত মূল্যটাও দিচ্ছে তারা। দেশের মাটিতে সাফ চ্যাম্পিয়ন জেতা ভারতকে হারিয়ে। হংকংয়ে চার জাতি টুর্নামেন্ট জিতল অনেকটা হেলায়। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তো এমন জয়ে অবাক। ‘ওদের খেলা দেখে সত্যিই অবাক আমি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যটা ছিল। তবে এতটা সহজেই হবে ভাবিনি।’ মালয়েশিয়া, ইরান আর হংকংয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচে ২৪ গোল করেছে মেয়েরা। ছোটনের মতে সফলতার পেছনে রয়েছে মেয়েদের প্রচণ্ড পরিশ্রম আর দলবদ্ধভাবে খেলার প্রশিক্ষণ। অনেকদূর এগিয়ে এসে পেছন ফিরে দেখার সুযোগ নেই। মাহফুজা আক্তার কিরণের মতে, ছোট ছোট এসব মেয়েদের পরের স্বপ্নটা ফিফা অনুর্ধ্ব-২০ মহিলা বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা। এরপর....! ওটা নাহয় গোপনই থাক।

ছোট ছোট মেয়েদের অজপাড়া গ্রাম থেকে তুলে এনে কেবল ফুটবলটাই শেখাচ্ছে না বাফুফে, পাশাপাশি শিক্ষিতও করে তুলছে। ওদের জন্য রাখা আছে প্রাইভেট টিউটর। উপযুক্ত সময়ে নিজেদের স্কুলে গিয়ে টেস্ট পরীক্ষা দিচ্ছে। অংশ নিচ্ছে ম্যাট্রিক পরীক্ষাতেও। প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে দলের প্রতিটা সদস্যই মাসোহারা পাচ্ছে। সবার কাছ থেকে ভালোবাসা, সম্মান আর উপযুক্ত ট্রেনিং পেয়ে সাফল্য এনে দিচ্ছেন মারিয়া মান্ডা, আঁখি খাতুন, তহুরা, শামসুন্নাহাররা। ক্ষুদে দলটার অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এখানে সাফল্য এনেছে। তবে এখানেই আমাদের শেষ নয়। সাফল্যের পথে হেঁটে আমরা যেতে চাই বহুদূর।’ বাফুফে সভাপতির ইচ্ছে, একদিন বাংলাদেশের মেয়েরা হবে এশিয়ার সেরা। তারপর প্রতিযোগিতা করবে বিশ্ব সেরাদের সঙ্গে। এশিয়ার সেরা হলে অবশ্য বিশ্ব সেরা হওয়ার পথটাও উন্মুক্ত। জাপানি মেয়েরা তো এরই মধ্যে ফিফা মহিলা বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছে।

সমাজের লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গেছে। এখন শামসুন্নাহারদের বাবা-মায়েদের সমাজে বাড়তি সম্মান জোটে। যারা দেশের লাল-সবুজ পতাকা ভিনদেশে উড়িয়ে আসে বীরত্বের সঙ্গে তাদের নিয়ে গর্ব করে পুরো জাতি। নতুন নতুন স্বপ্ন জাগে আশাহত মানুষের হৃদয়ে। প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়ার সময় গোপন ঘোষণা লেখা থাকে মানুষের চোখে মুখে। ‘তোমরা এরপর আরও ভালো খেলে এসো। আমরা তোমাদের এর চেয়েও জাঁকজমকপূর্ণ করে বরণ করে নেব।’ মাহফুজা আক্তার কিরণের মতে, সমাজের এই যে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের কারণেই। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, ‘যে দেশে খেলাপাগল এমন এক প্রধানমন্ত্রী আছে সেখানে উন্নতি তো হবেই।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর