শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমেরিকায় গাড়ি প্রকৌশলে বাংলার নারী

জেনারেল মোটরস, ফোর্ড মোটর কোম্পানি, ফিয়েট ক্রাইস্লার, হুন্দাই, হোন্ডা, টয়োটা গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে দেখা মিলবে বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীর

সাইফুল আজম সিদ্দিকী, মিশিগান থেকে

আমেরিকায় গাড়ি প্রকৌশলে বাংলার নারী

মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশিদের আগমন খুব বেশি দিন আগের নয়। এখানে নারী-পুরুষ সমানতালে এগিয়ে চলছে। গাড়ি নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মিশিগানে আমেরিকার বৃহত্তর সব গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর ও প্রকৌশল কেন্দ্র। জাপান ও জার্মান গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল কেন্দ্রও মিশিগানে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলার নারীরা। প্রকৌশল, ফিন্যান্স প্রশাসনসহ সব বিভাগেই তারা সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

আমেরিকায় প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা, গাড়ি প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি কিংবা চাকরিতে টিকে থাকা খুব সহজ নয়। বাংলার নারীরা কঠোর পরিশ্রম, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা, সৃষ্টিশীল মনন এবং প্রতিকূল পরিবেশকে উতরে সফলতার স্তরে।

 

তানজিমা মুস্তারিন, ফিচার ওনার, ড্রাইভার নোটিফিকেশন, কানেকটিভিটি

তিনি জেনারেল মোটরসে টেকনিক্যাল লিডার হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি নারী। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষ করে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় চলে আসেন। পারডু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষে জেনারেল মোটরসে যাত্রা শুরু। ১৯৯৮ সালে গাড়ি প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে কাজ করছেন গাড়ির বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল গ্রুপে। সফটওয়্যার লিড ও ইন্সট্রুমেন্ট ক্লসাটারের দায়িত্বও পালন করেছেন। প্রবাসী প্রকৌশলীদের সব অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি দেশের প্রতি অদম্য এক ভালোবাসারই প্রকাশ ঘটায়।

 

মৌলি আহমেদ, প্রকৌশলী ম্যানেজার, স্টেয়ারিং হুইল ও ড্রাইভার এয়ার ব্যাগ, জেনারেল মোটরস

গাড়ি প্রকৌশলে কাজ শুরু অটোমোটিভ সাপ্লায়ার কোম্পানি ডেলফাই অটোমোটিভ সিস্টেমসে। এর আগে কাজ করেছেন মেঘনা অটোমোটিভসে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে জেনারেল মোটরসে প্রকৌশলী ম্যানেজারে পদোন্নতি পান।

 

আফরোজা আক্তার, লিড অ্যানালাইসিস প্রকৌশলী, জেনারেল মোটরস

গাড়ি প্রকৌশলে কাজ করছেন ২০০০ সাল থেকে। গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ডেলফাইসহ আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সাড়ে ১০ বছর হয়ে গেল জেনারেল মোটরসে। নতুন টুল টেকনোলজি উদ্ভাবনে কাজ করেছেন, এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পড়াশোনা বুয়েটের যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলিনা থেকে মাস্টার্স করেছেন। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও কমিউনিটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছেন।

 

রেজওয়ানা হক, ক্যালিব্রেশন প্রকৌশলী, বশ

বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর করে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বিয়ের পর আমেরিকা প্রবাসী জীবন। কিছুদিন সংসার ও বাচ্চা সামলাতে বিরতিতে থাকলেও পরবর্তীতে ভর্তি হন মাস্টার্স প্রোগ্রামে। মাস্টার্স শেষে জার্মান অটোমোটিভ সাপ্লায়ার ‘বশ’ এ চাকরি শুরু করেন। ২০১২ সালে গাড়ির বডি ইলেকট্রিক ও হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস গ্রুপে কাজ করছেন।

 

মাসুমা খন্দকার, এরো থারমাল প্রকৌশলী, ফিয়েট ক্রাইস্লার অটোমোটিভ

বুয়েট যন্ত্র প্রকৌশল, ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটি ডেট্রয়েট থেকে মাস্টার্স। ব্যাচেলর করে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। প্রায় সাত বছর বর্তমান চাকরিতে। বর্তমানে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সংগঠনে সক্রিয় সদস্য। নতুন পড়তে আসা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের নাম মাসুমা।

 

নিগার সুলতানা রিম্পি- সিস্টেম প্রকৌশলী, ফোর্ড মোটর কোম্পানি

বাংলাদেশে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ব্যাচেলর করেন। দেশে গ্রামীণফোনে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন বছরখানেক। উচ্চশিক্ষার্থে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশলে মাস্টার্স করেই ফোর্ডে যোগ দেন। বাবা-মা ছেড়ে একা এতদূরে এসে পড়াশোনা- চাকরি সম্ভব হয়েছে তার একাগ্রতা আর উপরে ওঠার প্রেরণা।

 

মেহনাজ চৌধুরী, গ্লোবাল ক্যাপাসিটি প্ল্যানার, ফোর্ড মোটর

ফোর্ড কোম্পানিতে গ্লোবাল ক্যাপাসিটি প্ল্যানিং এ রয়েছেন তিনি। জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষে অ্যামাজন, টার্গেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তারপর ২০১৫ সালে ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে যোগ দেন। ফিন্যান্স ও প্ল্যানিংয়ের কাজ করছেন সফলতার সঙ্গে। ইতিমধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স ও প্ল্যানিংয়ের ওপর সার্টিফিকেট কোর্সও করেন।

 

নিপা দে, ব্যাটারি প্রকৌশলী, জেনারেল মোটরস

নিপা দে জিএম পদে কাজ করছেন প্রায় ৩ বছর। এইচএসসি পাস করে বাবা-মার সঙ্গে চলে আসেন মার্কিন মুল্লুকে। উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তির বিভিন্ন টেস্ট, ভ্যালিডেশন, প্রজেক্ট লিডারসহ বিভিন্ন পদে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে চলেছেন।

 

জিনাত নাজনিন লিজা, জেনারেল মোটরস

তিনি কোম্পানির গাড়ির রেয়ারভিও ক্যামেরার কাজ করেন। এর আগে প্যাসিভ সেইফটি ডিজাইনে অটোলিভ এবং এল্পস ইলেকট্রিকের হয়ে কাজ করেছেন। জিনাত মিশিগানের ওকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর করেছেন।

 

অনিয়া কুতুব, ভেলিডেশন প্রকৌশলী, জেনারেল মোটরস

অনিয়া এখানে কাজ শুরু করেন ২০১২ সালে। বর্তমানে গাড়ি নির্মাণ লাইনের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস সিমুলেশনে কাজ করছেন। লঞ্চ করে চলেছেন একের পর এক প্রোগ্রাম। বাংলাদেশে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচেলর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স।

 

শামসুন নাহার, অটোমোটিভ কন্ট্রোল প্রকৌশলী

২০০৮ সালে জেনারেল মোটরসে তার গাড়ি প্রকৌশলে পথ চলা শুরু। কাজ করেছেন ইঞ্জিন কেলিব্রেশনে, হাইব্রিড এল্পরিথম ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে। করবী বাশার, পাওয়ার ইলেকট্রিক ইনভারটার ডিজাইন, জেনারেল মোটরস। কাজ করেছেন ফিয়েট ক্রাইস্লার অটোমোটিভসে।

 

ফারাহ আহমেদ, কম্পিউটার আইডেড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএই) জেনারেল মোটরস

কানাডার রাজধানীর অটোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর  ও পরিবেশ প্রকৌশলে মাস্টার্স করে আড়াই বছর যাবৎ জেনারেল মোটরসে কর্মরত। বর্তমানে থাকেন মিশিগানে।

ফিয়েট ক্রাইস্লার অটোমোটিভ কোম্পানিতে সফল বাংলাদেশি নারীদের মাঝে রয়েছেন ব্যবস্থাপক সোমা হক। জেনারেল মোটরসের সায়েদা আহমেদ এখন আইটি টেস্ট এনালিস্ট। বুয়েট থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর শেষ করেছেন। ডেট্রয়েট মারসি ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে এমএস করেন। এ ছাড়া ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে রয়েছেন সাইফা, জেনারেল মোটরসে রয়েছেন তাসনিম এলিন, তানজিন হায়দার, শারমিন আক্তার, আদিবা ইসলাম, লিসা বেগম, রেজিনা নবী, সায়েদা আহমেদ। ফিয়েট ক্রাইস্লারের হোসনে আরা অভি কাজ করছেন গাড়ির প্লান্টে। গাড়ির সাপ্লায়ার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সাবরিনা রহমানসহ অনেকে।

‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’-বাংলা সাহিত্যের এক প্রচলিত প্রবাদ। পরবাসী সফল এ বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীরা সংসার সন্তান পরিবারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও সফল। নারী প্রকৌশলীরা অনেক সময় বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন। অনেকে পড়াশোনার পর বিয়ে হলে কোনো দিন চাকরির চেষ্টাও করেন না। এ বিষয়টি বেশি লক্ষণীয় যেসব নারী বিয়ের পর প্রবাসে চলে আসেন। গাড়ি প্রকৌশলের এ নারীরা হতে পারেন আমাদের রোল মডেল। বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলীরা সফলতার সঙ্গে গাড়ি নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। এগিয়ে আসছেন নেতৃত্বে। কর্মক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠছেন সফল ব্যবস্থাপক হিসেবে। এ সফল নারীরা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের মুখ।

সর্বশেষ খবর