শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিপ্লব ঘটাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ

জিন্নাতুন নূর

বিপ্লব ঘটাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ

নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে কাজ করলেও চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকা এবং উপকূলীয় এলাকাসহ প্রত্যন্ত এলাকায় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছতে আরও সময় লাগবে। তবে এসব মানুষ বিকল্প পথে ঠিকই বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছেন। বিকল্প সেই ব্যবস্থার নাম সৌরবিদ্যুৎ। জাতীয় গ্রিড থেকে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ যায়নি সেখানে বিদ্যুতের জন্য মানুষ ঘরে ঘরে লাগিয়েছে সোলার প্যানেল।

মূলত দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়বহুল হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ বিকল্প পথে সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য কাজ করছে। বিদ্যুতের সুবিধাবঞ্চিত এসব এলাকায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমেই বৈদ্যুতিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এক্ষেত্রে এটি বললে ভুল হবে না যে, বাংলাদেশের উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলছে সৌরবিদ্যুৎ। সরেজমিন দেশের পার্বত্য অঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় কিছু এলাকা ঘুরে মিলেছে এর সত্যতাও।

পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত এলাকা কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। প্রয়োজনীয় কাজ সারতে এখানকার মানুষ এখন সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। এই এলাকার গ্রামগুলোর টিনের তৈরি ঘরের ছাদে ছাদে ছোট ছোট সোলার প্যানেলের ছড়াছড়ি। এসব গ্রামের বাসিন্দারা বৈদ্যুতিক আলো, ফ্যান, টিভি ও মোবাইল ফোন চার্জ করার জন্য সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন।

আবার সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করেই দেশের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বর্তমানে তাদের বৈদ্যুতিক চাহিদা পূরণ করছেন। সরেজমিন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এই দুই জেলা ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট সোলার প্যানেল সেই এলাকার মানুষের ঘরে আলো পৌঁছে দিচ্ছে। সেখানে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস আর বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের বিদ্যুৎও যাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। এমনকি পাহাড়ি এলাকার স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং হোটেল, রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টও সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। আবার পাহাড় ঘিরে সম্ভাবনাময় যে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠছে সেখানেও সৌরবিদ্যুৎ এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত পর্যটন স্পট সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাকপাড়ায় লুসাই ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাস। এখানে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ছাড়াও আছে বেশ কিছু দোকান, খাওয়ার হোটেল ও পর্যটকদের থাকার রিসোর্ট। সমতল থেকে উঁচু পাহাড়ে অবস্থানের কারণে বিদ্যুতের জন্য এখানকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দাদের প্রতিটি ঘরের ছাদেই বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল। ব্যবহারকারীরা নিজ নিজ চাহিদামতো রাতের আঁধার দূর করতে কেউ ঘর আলোকিত করার কাজে আবার কেউ টেলিভিশন দেখতে সোলার প্যানেল ব্যবহার করছেন। কথা হলে কংলাকপাড়ার এক বাসিন্দা জানান, দুর্গম এলাকায় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য সৌরবিদ্যুৎ ছাড়া তাদের কাছে সাশ্রয়ী আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

আবার পর্যটনের ভালো সম্ভাবনা থাকায় এখানে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট। এর সবগুলোতেই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহূত হচ্ছে। কথা হলে মেঘপুঞ্জি রিসোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জসিম জানান, হাতেগোনা দুয়েকটি রিসোর্টে রাতে তিন-চার ঘণ্টা জেনারেটর চালানো হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু বেশির ভাগ রিসোর্টই বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।

এর বাইরে রাঙামাটির মগবান ইউনিয়নের বড়দাম বাজারে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বিনোদন স্পট ও রিসোর্ট। পর্যটকদের বৈদ্যুতিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসব রিসোর্টেও ব্যবহার হচ্ছে সোলার প্যানেল। ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটক সাইফুল ইসলাম জানান, দুর্গম এই পাহাড়ি এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। যা দেশি পর্যটন বিকাশেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব বেশিদিনের না হলেও সংশ্লিষ্টরা আসছে দিনে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরবিদ্যুেক ‘আশার আলো’ হিসেবে দেখছেন। সরকার এরই মধ্যে সোলার প্যানেল স্থাপন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও সৌর পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। আবার ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, গ্রাম ও মফস্বলের যেসব এলাকায় লোডশেডিংয়ের কারণে জনগণের দুর্ভোগ বেশি সেখানেও এখন বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এসব এলাকায় ব্যবহারকারীরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়াটের সৌরবিদ্যুতের প্যানেল ব্যবহার করছেন। এমনকি সেচকাজের জন্যও দিন দিন সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায় ৮০ শতাংশ অনুদান দিয়ে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রংপুর ও লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ দেওয়া হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২০ সালে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার অন্তত ১০ শতাংশ আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে পাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন, ব্যবহার ও প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও জানান, সরকার নির্বাচনের আগে দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে কাজ করলেও কিছু অঞ্চলে যেমন- চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকায় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছতে কিছু সময় লাগবে। এজন্য পার্বত্য এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মনপুরায় ‘সূর্যগ্রাম’ নামক প্রকল্প দিয়ে সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রকল্প নেওয়া হবে। বিদ্যুতায়ন করা হলে চরের মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিশ্বাস করেন।

সর্বশেষ খবর