শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
মো. পনির হোসেন

প্রথম বাংলাদেশির পুলিৎজার জয়

তানিয়া তুষ্টি

প্রথম বাংলাদেশির পুলিৎজার জয়

সাংবাদিকতায় প্রশংসনীয় অবদানে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি ‘পুলিত্জার’ পুরস্কার। আর সেই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হতে যাচ্ছেন প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ পনির হোসেন। তার আগে আর কোনো বাংলাদেশি পুলিত্জার পুরস্কার পাননি।

 

এত বড় একটি অর্জনে শুধু পনিরের জন্য নয়, বিশ্বের দরবারে আমাদের দেশের মর্যাদা বেড়ে গেল বহুগুণে। পনির যুক্তরাজ্যের সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক দলের অন্যতম একজন সদস্য। এ বছরই আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও ফটোগ্রাফিতে পনির হোসেনের দলের কৃতিত্বে রয়টার্স পুরস্কার পেয়েছে।

 

সাংবাদিকতায় গৌরব হিসেবে পুরস্কারটি এমন একসময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকরাও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গণমাধ্যমগুলো অনেক ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য ও পুঁজির কাছে আত্মসমর্পিত, সাধারণ নীতি-নৈতিকতা উপেক্ষিত বলে অভিহিত, তখন এমন একটি অর্জন অবশ্যই আশার সঞ্চার করে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা নিয়ে প্রকাশিত ১৬টি ছবি পুলিত্জার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। পুলিত্জার অর্জনকারী এসব ছবি তুলেছেন রয়টার্স ফটোগ্রাফি টিমের সাত সদস্য। এর মধ্যে তিনটি ছবি পনিরের হাতে তোলা। এসব ছবি তুলতে পনিরকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে কাদা পানির মধ্যে নেমে পনিরের দলকে ছবি তুলতে হয়েছে। ছবি তুলতে গিয়ে লেন্সের ভিতরে পানি ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এমনকি পানিতে নেমেও পনিরকে ছবিগুলো তুলতে হয়েছে।

 

পুলিৎজার পুরস্কার অজর্নকারী পনিরের ছবিতে একটি মানবিক বিষয় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। উপরের ছবি দুটির বাম পাশের ছবিতে দেখা গেছে, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার পর এক রোহিঙ্গা মা তার ৪০ দিনের শিশুর ঠোঁটে চুমু খেয়ে কাঁদছেন। হামিদা নামের ওই নারীর যমজ শিশুর একটি ওই নৌকাডুবিতে মারা গেছে।

 

দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে রোহিঙ্গা নর-নারী। তাদের আশ্রয়ের জন্য একটি শনের ঘর পর্যন্ত তখন আর নেই। তাই হাতের একটি মাত্র ছাতা-ই সম্বল। ছেলেবুড়ো সবাই আশ্রয় নিয়েছেন ছাতার নিচে। পনিরের তোলা পুরস্কার বিজয়ী তিন নম্বর ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কলাগাছের তৈরি ভেলায় করে নাফ নদ পাড়ি দিচ্ছে এক দল রোহিঙ্গা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই অনিরাপদ যাত্রা মানুষকে কতটা অসহায়ত্বের নির্দেশক তা পনিরের ছবি দেখলে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়।

 

পনিরের হাইস্কুল জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন ঢাকার সিটি কলেজে। এরপর বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। তারপর ফিলিপাইনের অ্যাতেনিও ডি ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজমের ওপর উচ্চশিক্ষা নেন। ২০১০ সাল থেকে পনির হোসেন ছবি তুলতেন শখের বসে। সেই শখই একদিন তার পেশা হয়ে দাঁড়াল। শুরুতে তিনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৫ সালে তিনি রয়টার্সে যোগদান করেন। তবে ২০১৬ সালটা ছিল তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর। ওই বছরই তিনি যোগ দেন রয়টার্সে এবং সেদিনটাতে যেদিন গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা হয়। সেই হামলার ছবি তুলতে হয়েছিল তাকে। তবে সেদিন ভয় নয়, সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নিজের কাজে।

 

রয়টার্সের প্রধান সম্পাদক স্টিফেন জে অ্যাডলার বলেন, এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া বিষয়-আশয় নিয়ে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেশির ভাগ পুলিত্জার দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। গভীর উদ্বেগ ও গুরুত্বসহকারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুগুলোতে আলোকপাত করতে পারায় আমরা গর্ববোধ করছি। অ্যাডলার বলেন, ফিলিপাইনে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতিবেদন করেছেন ক্লেয়ারি বল্ডউইন, অ্যান্ড্রু আর সি মার্শাল ও ম্যানুয়েল মংগাটো। দায়মুক্তি নিয়ে বিনা বিচারে কীভাবে পুলিশ মাদকের নামে মানুষ হত্যা করেছে, তা-ই ছিল তাদের প্রতিবেদনের মূল বিষয়। এদিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়নকে আলোকচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরায় রয়টার্স ফটো সাংবাদিকদের এ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।

 

অ্যাডলার বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল নিয়ে এটি ছিল এক অসাধারণ ফটোগ্রাফি। এতে সহিংসতায় যে মানবমূল্য দিতে হয়েছে কেবল তা-ই নয়, এটি ফটো সাংবাদিকতায় এক অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। রাখাইন রাজ্যে ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যার ঘটনায় অনুসন্ধানে গিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদক ওয়া লোন ও কিইয়াও সো ও কারাগারে আটক রয়েছেন। ১২ ডিসেম্বর ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল গোপনীয় আইনে তাদের আটক করা হয়েছিল।

 

পুলিৎজার পুরস্কার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাপার সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সংগীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত পুলিত্জার পুরস্কার। নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এই পুরস্কারের প্রশাসক হিসেবে কাজ করে। ১৯১৭ সালের ৪ জুন প্রথম পুলিত্জার পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে পুরস্কারটি প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে ঘোষিত হয়। একটি স্বাধীন বোর্ডের মাধ্যমে বিজয়ীদের নির্বাচন করা হয়। প্রতিবছর ২১টি ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা এই পুরস্কার পেয়ে থাকেন। পাবলিক সার্ভিস বিভাগে বিজয়ীরা স্বর্ণপদক লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও সংবাদ সংস্থায় নিয়মিত প্রকাশিত প্রতিবেদন ও আলোকচিত্র সাংবাদিকতা এই পুরস্কারের যোগ্য হয়। ২০০৭ সালের শুরু থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, সব অনলাইন সংবাদও সাংবাদিকতা পুরস্কারের আওতায় নেওয়া হবে, শুধু দুটি আলোকচিত্র বিভাগের পুরস্কার দেওয়া হবে না।

সর্বশেষ খবর