শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

পরিবেশবান্ধব টেক্সটাইল প্রযুক্তি উদ্ভাবন

মর্তুজা নূর, রাবি প্রতিনিধি

পরিবেশবান্ধব টেক্সটাইল প্রযুক্তি উদ্ভাবন

অধ্যাপক ড. তৌফিক আলম এবং তার উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব টেক্সটাইল প্রযুক্তি

টেক্সটাইল শিল্প কারখানা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে শত শত শ্রমিকে ঠাসাঠাসি কোন জায়গা, ব্যস্ততা, পরিবেশ দূষণ আর বিদঘুটে  কেমিক্যালের গন্ধ। যেখানে ফাইবারজাত কৃষি পণ্য যেমন- পাট ও তুলা, ভেড়া পশম, সিল্ক ফাইবার সৃষ্টিকারী মথ পোকা থেকে ফাইবাররূপি কাঁচামাল বের করা হয়। এরপরে আসে সেই কাঁচামাল থেকে পর্যায়ক্রমে সুতা, ফেব্রিক ও পোশাকের রূপান্তর কাজ। যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে স্পিনিং মিল, উইভিং মিল, নিটিং মিল, ডাইং ও গার্মেন্টস মিল। এখানেই শেষ নয়। এর বাইরে রয়েছে বোতাম, জিপার, সেলাই মেশিন, শেলাই সুতা, নিটিং করার জন্য প্রয়োজনীয় ধাতব দণ্ড, লেচ, তাঁত, বস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যবহার্য সামগ্রী। যা দিয়ে সৃষ্টি হয় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি।

বর্তমানে টেক্সটাইল মানব ইতিহাসের একটি অন্যতম প্রধান শিল্প। যা একাধারে কৃষিজাত কাঁচামাল, বৈচিত্র্যময় উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের বিতরণ ব্যবস্থার সমন্বয়ে অনেক জটিলাকার একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই টেক্সটাইল শিল্প এদেশের অর্থনীতিকে সবসময় গতিশীল রাখছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি দেশ টেক্সটাইলের হাত ধরেই উন্নত টেকনোলজিতে যায়। যখন চীন ও ভারত তাদের নানা সমস্যার কারণে তাদের টেক্সটাইল ক্যাটাগরিগুলো ছেড়ে দিচ্ছে তখন বাংলাদেশের সামনে এক অপার সম্ভাবনা। কিন্তু বাংলাদেশ এই সুবিধাটি কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এই শিল্পটি বর্তমানে সম্মুখীন হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জের। এর অন্যতম এক কারণ- টেক্সটাইলে শিল্প উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে ব্যবহূত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও রং এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়াসহ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমা পানি পরিবেশ থেকে আহরণ করা হয়। যা পরিবেশের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকির কারণ।

আর এই হুমকি থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য টেকসই ও ‘পরিবেশবান্ধব’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তৌফিক আলম। যা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে পানি ও জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং ‘টেক্সটাইল প্রি-ট্রিটমেন্ট’-এর ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

ড. তৌফিক আলম বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরের মানুষ যত পানি ব্যবহার করেন তার দ্বিগুণ পানি ব্যবহার করে টেক্সটাইল শিল্পগুলো। যা মূলত ‘টেক্সটাইল প্রি-ট্রিটমেন্ট’-এর ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়। তাই আমরা যে প্রযুক্তির উন্নয়ন করেছি তা ‘প্রি-ট্রিটমেন্ট’ এর ক্ষেত্রে শতকরা ৪৫ ভাগ পানির সাশ্রয় করবে ও পরিবেশ দূষণ সর্বনিম্নে নিয়ে যাবে।

এ গবেষণার জন্য অধ্যাপক ড. মো. তৌফিক আলমকে সহযোগিতা করেছেন একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. শামীম আহসান এবং ৭ জন শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ৫ জন এম.এস-সি ও ২ জন পি.এইচ-ডি গবেষক শিক্ষার্থী রয়েছেন। আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া গেছে হেকেপ প্রজেক্ট থেকে। সাফল্যের জন্য গত চার বছর কাজ করছেন।

অধ্যাপক ড. তৌফিক আলম আরও বলেন, গ্রেইজ ফেব্রিকগুলো প্রথমেই ডাইং এর উপযোগী থাকে না। এসব কাপড়ে তেল, চর্বি, মোম, গ্রিজ, প্রোটিন, প্রাকৃতিক রঙ, হেয়ারি ফাইবার ও অন্যান্য অপদ্রব্য লেগে থাকে। ডাইং করার আগে এসব অপদ্রব্য দূর করে নেওয়াই ‘প্রি-ট্রিটমেন্ট’ এর প্রধান কাজ। এই ‘প্রি-ট্রিটমেন্টের’ জন্য মূলত দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রথমটি প্রচলিত কস্টিক সোডা-পারঅক্সাইড পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি ব্যবহূত হলেও ফেব্রিক ডাইং- এ ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। ফলে এই প্রক্রিয়াটি অধিক ব্যবহূত হয়। দ্বিতীয়টি উেসচক (এনজাইমেটিক) পদ্ধতি, যা পরিবেশবান্ধব ও পানি সাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ার কারণে এর ব্যবহার সীমিত। এক্ষেত্রে আমরা একটি সক্রিয়ক (একটিভেটর) ব্যবহার করে উেসচক  গতানুগতিক ফলাফলকে অতিক্রম করে প্রচলিত পদ্ধতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। এ ছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রি-ট্রিটমেন্ট চার থেকে পাঁচ ধাপে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু উদ্ভাবিত পদ্ধতি এক ধাপে সংঘটিত হবে, ফলে পানির পাশাপাশি সময় ও জ্বালানি সাশ্রয়ও হবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। তাদের এই উদ্ভাবন পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টদের কাছে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও মেশিনারিজ প্রদর্শনী (ডিটিজি-২০১৮) তে প্রদর্শিত হয়। গত ৮-১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি তারা বাংলাদেশের কয়েকটি টেক্সটাইল শিল্প কারখানায় তাদের এ সাফল্যের কথা জানিয়েছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এ উদ্ভাবন পরীক্ষা করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয়ী এই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির সফল প্রয়োগ একদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুুরো দেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে অনেক গবেষক ও শিক্ষক আশা প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ খবর