শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
কক্সবাজার

কানা রাজার সুড়ঙ্গ

আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

কানা রাজার সুড়ঙ্গ

কক্সবাজারের রামুতে আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গটি আলোর মুখ দেখলেই গড়ে উঠতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো এ সুড়ঙ্গ সংস্কার হলেই ওই স্থানটি গড়ে উঠবে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা নামক দুর্গম এলাকায় রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই আঁধার মানিক। যা স্থানীয়ভাবে কানা রাজার সুড়ঙ্গ (গুহা) হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থ ছাড়াও পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত পাকিস্তান পর্যটন ডিপার্টমেন্ট ট্যুরিস্ট গাইডে রামুর এই আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গের কথা লিপিবদ্ধ ছিল।

দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা এই ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গটি ফের উন্মোচন করেছেন রামুর একঝাঁক ছাত্র-যুবক। এদের মধ্যে একজন রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের বাসিন্দা ছড়াকার কামাল হোসেন জানান, তারা  সেই ছোটকাল থেকে এ সুড়ঙ্গটির কথা লোকমুখে শুনে আসছিলেন। পরে বিভিন্ন পুরনো এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বইতেও সুড়ঙ্গটির তথ্য জানতে পারেন। কিন্তু অযত্ন-অবহেলা ও প্রচারের অভাবে সুড়ঙ্গটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

স্থানীয় শিক্ষক তাজউদ্দিন ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান, বিষয়টি নিয়ে এলাকায় আলাপ-আলোচনা হলেই সম্প্রতি সুড়ঙ্গটি অনেকেই দেখতে যান। কিন্তু সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখটি তখন পাহাড়ের মাটি ও জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই মাটি ও জঙ্গল কেটে সুড়ঙ্গ  যেন ফের আবিষ্কার করল সবাই। সুড়ঙ্গের ভিতরে গিয়ে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এ যেন জীবন্ত গুহা।

 

আঁধার মানিকের ইতিহাস

রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা এলাকার আঁধার মানিক স্থানীয়ভাবে কানা রাজার সুড়ঙ্গ (গুহা) হিসেবে পরিচিত ছিল। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এটিকে রাজা চিন পিয়ান বা কিংবেরিংয়ের উদ্বাস্তু জীবনের শেষ সময়কালের আশ্রয়স্থল বা দুর্গ বলে ধারণা করা হতো। কথিত আছে বর্মী সেনা ও বর্মী অনুগত আরাকানিদের ওপর অত্যাচার করার কারণে প্রতিপক্ষের সংঘবদ্ধ আক্রমণে পরাজিত হয়ে চিন পিয়ান বৃহত্তর চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেন। তাকে গ্রেফতার করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য চিন পিয়ান পুনরায় আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও বর্মীদের পাল্টা প্রতিরোধের কারণে তিনি রামুর পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয়  নেন। এখানে থাকাকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ের গভীরে খনন করা হয় এই গোপন সুড়ঙ্গ বা দুর্গ।

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী তানভীর সরওয়ার রানা জানিয়েছেন, এলাকার একঝাঁক ছাত্র-যুবক সম্প্রতি কাউয়ারখোপ হাকিম-রকিমা উচ্চ বিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তী স্মরণিকার প্রচ্ছদের জন্য আমাকে আঁধার মানিকের ছবি এঁকে দিতে বলেন। এ সময় আমি ছবি আঁকার উদ্দেশ্যে গুহাটি সরেজমিন দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। সে অনুযায়ী গত ২৩ মার্চ দুর্গম ওই এলাকায় গিয়ে আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গ দেখে অন্যদের মতো আমি বিস্মিত হই। ওই দিনই গুহাটি আমাদেন নতুন করে খোঁজে নিতে হয়েছে।

তিনি আরও জানান, এটি কেবল একটি সুড়ঙ্গ নয়, এটি একটি হাজার বছরের ইতিহাস। ঐতিহাসিক পটভূমি ও লোকমুখে জানা তথ্যমতে, এটি অনেক দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ বিশেষ বা কোনো প্রতাপশালী রাজার নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা  সেনা ক্যাম্পও হতে পারে। এ সুড়ঙ্গটিকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানান। এজন্য তিনি দেশের প্রত্নতত্ত্ববিদ, প্রশাসনিক ব্যক্তি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।

কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা গ্রামের বাসিন্দা ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য শামসুল আলম জানিয়েছেন, তার গ্রাম থেকে একটু দূরেই এ আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গ। ছোটবেলায় তিনি কয়েকবার স্থানীয়দের সঙ্গে ওই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছেন। তিনি সেখানে প্রায় ১০০ ফুট ভিতরে গিয়েছিলেন। সেই সুড়ঙ্গের ভিতরে একটি রঙ্গশালা বা মঞ্চ রয়েছে। যাকে অনেকে বিশ্রামাগারও বলে। আবার সেই সুড়ঙ্গের ভিতরে কিছু দূর গেলেই দেখা মিলত ৩টি সুড়ঙ্গ পথের মোহনা। তার ধারণা এ সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে কয়েকটি সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হওয়ার পথ ছিল। শামসুল আলম আরও জানান, একসময় এখানে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব চলাকালে মিয়ানমারসহ আশপাশের রাখাইন ও বৌদ্ধ নারী-পুরুষ এ সুড়ঙ্গ দেখতে আসত।

একই এলাকার উখিয়ারঘোনা গ্রামের অমিয় বড়ুয়ার স্ত্রী ৭০ বছরের বানুবালা বড়ুয়া জানিয়েছেন, শিশু বয়সে তিনি ওই স্থানে  অনেকবার গিয়েছিলেন। ওই স্থানে আসতেন অনেকেই মূল্যবান সম্পদের খোঁজে। এখনো ওই স্থানে অনেক মূল্যবান সম্পদ থাকতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি। গত ২৩ মার্চ সকালে আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গ মাটি ও জঙ্গল কেটে উন্মোচনের পর সুড়ঙ্গের সম্মুখে সবুজ প্রান্তরে চলে প্রাণবন্ত আড্ডা। এতে রামুর পর্যটনশিল্প বিকাশে আঁধার মানিক বা কানা রাজার সুড়ঙ্গকে বিকশিত করতে করণীয় নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী তানভীর সরওয়ার রানা। আঁধার মানিকের ঐতিহাসিক পটভূমি পাঠ করেন ছড়াকার কামাল হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক সোয়েব সাঈদ ও আবুল কাসেম সাগর। সুড়ঙ্গ নতুনভাবে উন্মোচন ও আড্ডায় আরও অংশ নেন শিক্ষক তাজউদ্দিন, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও আবুল কালাম আবু, নজরুল ইসলাম খোকন, সুলতান আহমদ, ছাত্রনেতা মোহাম্মদ নোমান, নুওয়াইছির আরাফাত সোহেল, শাহীন আলম, জসিম উদ্দিন, আবদুর রহিম, আবুল কালাম, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, স্থানীয় বাসিন্দা তাতু বড়ুয়া, ফয়সাল, ওবাইদুল হক প্রমুখ।  স্থানীয়দের দাবি, রামুর এ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংস্কার করা হলেই বাড়বে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে এটি। রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাজাহান আলী জানিয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন হিসেবে এ সুড়ঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর