শনিবার, ১৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ

খ্যাতির শীর্ষে ড. আতিক রহমান

তানিয়া তুষ্টি

খ্যাতির শীর্ষে ড. আতিক রহমান

ড. আতিক রহমান দক্ষিণ এশিয়ার খ্যাতিমান পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং একজন স্বপ্নদর্শী চিন্তাবিদ। পরিবেশ ও প্রকৃতির সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই উন্নয়নে তার অগ্রগামী ভূমিকা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবদানের জন্য ড. আতিক রহমান বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ২০০৭ সালে আইপিসিসি যৌথ নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলে তিনি ছিলেন এর সহ-প্রাপক। ২০০৮ সালে ড. রহমান লাভ করেন জাতিসংঘের অত্যন্ত সম্মানিত পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’।

 

ড. আতিক রহমান দক্ষিণ এশিয়ার খ্যাতিমান পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং একজন স্বপ্নদর্শী চিন্তাবিদ। পরিবেশ ও প্রকৃতির সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই উন্নয়নে তার অগ্রগামী ভূমিকা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবদানের জন্য ড. আতিক রহমান বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ ২০০৮ পান। পৃথিবীর পরিবেশের সুরক্ষা, আঞ্চলিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তার অসামান্য অবদান, অনুপ্রেরণীয় নেতৃত্ব এবং বিশ্বব্যাপী টেকসই ব্যবস্থাপনার স্বীকৃতির জন্য তাকে সম্মানিত করা হয়। একই বছর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আরও একটি অসাধারণ সম্মাননা ‘জাতীয় পরিবেশ পদক’ পান। মৌলিক উদ্ভাবনী পরিবেশগত গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন বিভাগে তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পরিবেশ বিষয়ে ড. রহমানের গবেষণাপত্র প্রাকৃতিক সম্পদ, উন্নয়ন, দারিদ্র্য, সুশাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো দেশ এবং বিদেশের গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং উন্নয়নকর্মীদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে অনুপ্রেরণামূলক ভূমিকা পালন করে। তিনি ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর প্রধান লেখক ছিলেন। ২০০৭ সালে অসামান্য অবদানের জন্য আইপিসিসি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলে ড. আতিক রহমান এর সহ-প্রাপক ছিলেন। সে বছর শান্তিতে যৌথ পুরস্কার পান আইপিসিসি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর। ড. এ আতিক রহমানের বাবা এম এম খবির উদ্দিন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৪৭ সালের পর তিনি বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার আজিমপুর নয়াপল্টন এলাকায় একটি বাড়িও করেছিলেন তিনি। ওই বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে থাকতেন খবির উদ্দিন। তার পুত্র আতিক রহমান ছোটবেলা থেকে একাডেমিক পরীক্ষায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। পলাশী ব্যারাক স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। দুরন্ত স্বভাবের ছোট্ট আতিক সেখান থেকে ১৯৬০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। ওয়েস্টার্ন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই বয়সে আশপাশের অমনোযোগী ছাত্রদের দেখলেই পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিতেন। এভাবে একটু একটু করে সামাজিক দায়িত্ব পালন শুরু করে দেন। এভাবে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সপ্তম শ্রেণিতে উঠলে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে চলে যান। এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ নম্বরের জন্য দ্বিতীয় হয়েছিলেন ড. রহমান। ভালো ফলাফলের জন্য ঢাকা বোর্ডের পক্ষ থেকে তাকে দুটি গোল্ড মেডেল দেওয়া হয়। গোল্ড মেডেলের একটি ছিল সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার জন্য অপরটি প্রথমবারের মতো সাধারণ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়ার জন্য। এরপর আইএসসি পাস করেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়বেন। কিন্তু শেষমেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়তে হয়। ড. আতিক রহমান বলেন, ‘হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলাম আমরা। প্রথম বর্ষেই নিজের জন্য আলাদা একটি কক্ষ পাওয়া মানে তখনকার সময় আমাদের কাছে বিশাল কিছু। আমার একটি লাল বাই-সাইকেল ছিল। বাই-সাইকেলে চেপে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতাম। তখন আমি পাকিস্তান অবজারভারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে খুব বেশি উপভোগ করতাম। কিন্তু অনার্সের শেষ বর্ষের প্র্যাক্টিক্যালের ঠিক আগ মুহূর্তে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে অনার্স শেষ হয়। এমএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি।

স্বাধীনতার কিছুদিন পর প্রথম কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে চলে যাই বিলেত। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এনার্জি ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে কাজ শুরু করি। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল কম শক্তি দিয়ে বেশি কাজ করার উপায় উদ্ভাবন কীভাবে করা যায়। কিন্তু গবেষণা শুরুর এক পর্যায়ে আমার তত্ত্বাবধায়ক ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য মারা যাওয়ায় উচ্চতর পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ভেবে দেখলাম আমার জন্য লন্ডনই উপযুক্ত হবে। কারণ সেখানে আমার বন্ধু ও পরিচিত জনদের পাওয়া যাবে। অন্তত আড্ডা দিতেও নিজের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। তখন ওয়েস্ট লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সেখান থেকে শিল্প ও ফলিত রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি।’ তারপর আবার অধ্যাপনা ও গবেষণায় মনোযোগ দেন ড. রহমান। এবার পোস্ট ডক্টরাল পড়াশোনা ও গবেষণায় যোগ দিল। এরপর ফ্রান্সে সলিড লিকুইডিটি নিয়ে ব্যাপ্টিস্ট ডোনেট এর অধীনে গবেষণা করেন।  ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশে তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৭ সালে অক্সফোর্ডে যোগদান করেন।

ড. আতিক রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ট্রাফট ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসিসহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন, ডিপ্লোমেসি ও টেকসই উন্নয়নের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইটি), ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউএসএর নগর অধ্যয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের টেকসই উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ এবং উত্তর সাউথ ডায়ালগে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স ডিজাইন এবং বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের স্থায়িত্ব চ্যালেঞ্জ ফাউন্ডেশনের জন্য স্থায়িত্ব ব্যবস্থাপনা (আইপিএমএস) আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের অনুষদ সদস্য ছিলেন। তিনি ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া (কানসা) সহ-চেয়ারম্যান এবং আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস ফর পোভার্টি এলিভাইটিশন (ইএসপিএ) -এর সহ-চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউকে গবেষণা কাউন্সিল এবং ডিএফআইডি এর গবেষণা অনুদান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৬ সালে ড. সালিমুল হকের সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)। এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন ড. আতিক রহমান। বর্তমানে একাধিক উচ্চতর গবেষণা তত্ত্বাবধান ও মৌলিক গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। তিনি এই এনজিওকে পরিবেশ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক একটি অগ্রণী চিন্তায় রূপান্তরিত করেছেন। এখানে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ও এর বাইরে ড. রহমানের দক্ষতা অপরিহার্য। কারণ তিনি বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেন। একজন বিজ্ঞানী, লেখক ও পরামর্শক হিসেবে ড. আতিক রহমানের একাধিক আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা রয়েছে। তার উদ্যোগে বিশ্বখ্যাত ম্যাসুসেয়েট ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইটি)-তে চালু হয়েছে টেকসই উন্নয়নের ওপর একটি নতুন স্নাতকোত্তর কোর্স। এ ছাড়াও তিনি আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার আহ্বায়ক ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া (কানসা) এবং পরিবেশ ও দারিদ্র্যবিষয়ক গ্লোবাল ফোরাম (জিএফইপি) এবং UNCED-এর সমন্বয়কারী। ড. রহমান বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইউএনডিপি, ইউএনডিইএসএ, ইউএনইপি, আইএফএডি, এসক্যাপ, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ইউনেস্কোসহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওদের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। তিনি টেকসই উন্নয়ন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য এবং সমতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বৈশ্বিক শাসন এবং ভারী নির্মাণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের বিস্তর অভিজ্ঞতার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব অ্যাকশন (এনএপিএ) এবং আইপিইসির প্রধান লেখক দলের নেতৃত্বের প্রধান কাজটি তার ভলিউমের প্রধান হাইলাইট হিসেবে রাখা হয়েছে। ড. রহমান বিভিন্ন নেটওয়ার্ক এবং সংস্থার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি পরিবেশ ও দারিদ্র্য (গ্লোবাল ফোরাম অন গ্লোবাল ফোরাম)-এর সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান (এনইএমএপি)-এর সিনথেশিস কমিটির সভাপতি। ম্যানিলায় অবস্থিত এশিয়া প্যাসিফিক ন্যাশনাল কাউন্সিলের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ড. রহমান দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য কমিশনের বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত অনুসরণ এবং সে অনুযায়ী নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিলের ওয়ার্ল্ড এনার্জি অ্যাসেসমেন্টের (১৯৯৯) অন্যতম বিজ্ঞ সমালোচক।

ড. আতিকের লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে ‘গ্রাউন্ডওয়াটার রিসোর্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’-এ ২০০৩ সালে লেখা বইটিতে আর্সেনিকের সমস্যা, চাষাবাদের সম্ভাবনা এবং পরিবেশ নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বইটির সহ-লেখক ছিলেন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী পিটার রিভেন্সক্রফট। তার সম্পাদনায় বের হয়েছে ‘মেইনস্ট্রিমিং অ্যাডাপ্টিং টু ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ’। ৫ জন লেখকের মধ্যে তিনি এবং ড. সালিমুল হক আছেন। ‘এক্সপ্লোডিং দ্য পপুলেশন মিথ কনজামসন ভার্সেস পপুলেশন’ বইটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে। দুজন লেখকের সঙ্গে তিনি ছিলেন সহ-লেখক। এ ছাড়াও বিশ্বের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত গবেষণা জার্নাল নেচারে তার একাধিক গবেষণাপত্র মুদ্রিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর