শনিবার, ১৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঘুরে বেড়াই

আজমির শরিফে একদিন

আজমির শরিফে একদিন

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক মঈনুদ্দিন চিশতি। তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছেন ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার বক্তব্য। তার জন্ম ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে ও মৃত্যু ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে। তার সমাধি রয়েছে ভারতের রাজস্থানের আজমির শরিফ। ঘুরে এসে লিখেছেন— গাজী মুনছুর আজিজ

 

মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে পা রাখতেই একটি কথা মনে পড়ল। সেটি হলো, এ মাজারে আসার জন্য আশপাশের অনেককে মানত করতে দেখেছি। তবে আমার কোনো মানত নেই। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হিসেবে তার মাজার দর্শনই আমার উদ্দেশ্য। সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ আমার এ দর্শনের সঙ্গী। অবশ্য তার কোনো মানত আছে কিনা তা জানি না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের এক নব দম্পতি এসেছেন মানত করেই। তাদের সঙ্গে পরিচয় কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লির পথে। দিল্লি থেকে রাতের বাসে রওনা হয়ে সকাল ১০টার দিকে আসি রাজস্থানের আজমির শরিফ বাসস্ট্যান্ড। তারপর ট্যাক্সিতে মাজারের গেট। গেট থেকে হেঁটে রওনা হই মাজারের উদ্দেশে। গেট থেকে মাজারে যাওয়ার এ পথের দুইপাশে অসংখ্য দোকান, আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি অধিকাংশ দোকানেই সাজানো— গিলাফ, আগরবাতি, মোমবাতি, মিষ্টিজাতীয় শুকনা খাবার ইত্যাদি। আবার কিছু দোকানে অনটাইম প্লেটে সাজানো লাল গোলাপের পাপড়িসহ বিভিন্ন ফুল। গিলাফগুলো লাল, নীল, হলুদ, খয়েরিসহ বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের। এসব গিলাফের গায়ে অ্যামব্রয়ডারি বা প্রিন্টের মাধ্যমে কোরআনের আয়াত বা আরবি ক্যালিগ্রাফি আঁকা।

মাজারে আসা পুণ্যার্থীরা এসব কিনেন দান বা মানতের অনুষঙ্গ হিসেবে। আমরা প্রথমে আসি মাজারের খাদেম সৈয়দ সারওয়ার চিশতির কাছে। খাদেম সাহেব আমাদের সঙ্গে আসা নব দম্পতির পারিবারিক পরিচিত। তারা খাদেম সাহেবের হোটেলে উঠেন। আমি আর আসাদ ভাই আসি মাজার দর্শনে। নানা বয়সী পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখর মাজার প্রাঙ্গণ। মুসলমান ও সনাতনধর্মীদের ভিড়ে আছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অসংখ্য পর্যটক-পুণ্যার্থী। মাজারের একপাশে বৈঠক খানার মতো আছে। এ বৈঠক খানায় মাজারের খাদেমরা খাতা-কলম নিয়ে বসে আছেন। পুণ্যার্থীরা এসে এখানে নাম লেখান। মাজার প্রাঙ্গণে বেশ বড় দুইটা পিতলের পাতিল আছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠি পাতিলের ভিতর দেখার জন্য। পাতিলের ভিতর পুণ্যার্থীরা দানের টাকা-পয়সা ফেলেন। মাজার প্রাঙ্গণে অজুর জন্য পাকা পুকুর আছে। এ পুকুরের চারপাশে বসে মানুষ অজু করেন। মাজার প্রাঙ্গণে মসজিদ আছে। নান্দনিক নকশা ও কারুকার্য দেখে বোঝা যায় মসজিদটি প্রাচীন। অনেক পুণ্যার্থীকে দেখি মাজার আঙ্গিনায় প্রবেশ করছেন গিলাফ নিয়ে দলবেঁধে। চারপাশে চারজন গিলাফটি ধরেন সামিয়ানার মতো করে। আবার অনেকেই গিলাফ ভাঁজ করে আনছেন। গিলাফের সঙ্গে আরও আনছেন প্লেটভর্তি ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি বা শুকনা মিষ্টিজাতীয় খাবার। পুণ্যার্থীরা এসব দান বা মানতের অনুষঙ্গ নিয়ে মঈনুদ্দিন চিশতির সমাধি ঘরের একপাশ দিয়ে প্রবেশ করেন এবং সমাধি পরিদর্শন শেষে অন্যপাশ দিয়ে বের হন। মঈনুদ্দিন চিশতির সমাধির পাশে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে হারমনি-তবলা বাজিয়ে কাওয়ালি পরিবেশন করেন একদল পুণ্যার্থী। অন্য পুণ্যার্থীরা বসে তা শুনেন। আবার আরেক দল পুণ্যার্থী মাজার প্রাঙ্গণে হেঁটে হেঁটে কাওয়ালি পরিবেশন করেন। মাজার প্রাঙ্গণের পাশেও আছে গিলাফ, আগরবাতি, মোমবাতি বা ফুলের অনেক দোকান। কিছুক্ষণ মাজার প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করে বসি কাওয়ালির আসরে। মঈনুদ্দিন চিশতি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি বা খাজা গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত।

চিশতিয়া সুফি তরিকার অন্যতম প্রচারক বা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হিসেবেই মূলত তিনি পরিচিত। এ তরিকার মূল বক্তব্য— ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী তিনি পূর্ব পারস্যের সিসটান রাজ্যের চিশতিতে ৫৩৬ হিজরি বা ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পনেরো বছর বয়সে তার বাবা-মা মারা যান।

তিনি তার বাবার কাছ থেকে একটি উইন্ডমিল ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে পান। লোকমুখে প্রচলিত, একদিন তিনি তার ফলবাগানে পানি দিচ্ছেন এমন সময় বাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী। মঈনুদ্দিন কুন্দুজীকে ফল দিয়ে আপ্যায়ন করান। প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মঈনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি খেতে দেন। এরপর মঈনুদ্দিন তার সব সম্পদ গরিবদের মাঝে বিতরণ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখান থেকে আসেন নিশাপুর। সেখানে চিশতিয়া তরিকার প্রসি সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন। মঈনুদ্দিন চিশতি অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সহচর্যে ৫৭ দিন ছিলেন বলেও প্রচলিত আছে।

তিনি আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর এবং পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করে ধর্ম প্রচার করেন। তার অনুসারী বখতিয়ার কাকি, বাবা ফরিদ, নাজিমদ্দিন আউলিয়াসহ অনেক সুফি সাধক। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে বা ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

কেনাকাটা

আজমির শরিফের গেটের আশপাশে কেনাকাটার অনেক দোকান আছে। পোশাক, দার্জিলিংয়ের চা, কাশ্মীরের রেশমি কাপড়, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ বা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের তাঁতের কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যগুলো পাবেন এসব দোকানে। বিশেষ করে পাবেন মিষ্টি জাতীয় বিভিন্ন শুকনা খাবার। এক দামের দোকান ছাড়া দরদাম কেরে কেনার সুযোগ আছে। তবে যেখানে একদাম সেখানে দরদাম না করাই ভালো।

 

যেখানে থাকবেন

আজমির শরিফের গেটের কাছে অসংখ্য হোটেল আছে। ভাড়া ৬০০ রুপি থেকে শুরু  করে ৬ হাজার রুপি পর্যন্ত। 

 

কীভাবে যাবেন

বাস, ট্রেন বা বিমানে কলকাতা। শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস বা দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে দিল্লি। কলকাতা থেকে বিমানেও দিল্লি যেতে পারেন। দিল্লি থেকে আজমির শরিফের এসিবাস আছে। সকাল ও রাতে এ বাস ছাড়ে। পাহাড়গঞ্জ এলাকার হোটেলগুলোতে এ বাসের খোঁজ মিলবে। এ ছাড়া বাসস্ট্যান্ডেও পাবেন এ বাস। রাতের বাসে উঠলে সকালে পৌঁছাবেন আজমির বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে অটোতে আজমিরের গেট। আজমির শরিফ থেকে দিনের বেলায় দিল্লির লোকাল বাস আছে। আর রাতে পাবেন এসিবাস।

 

খাওয়া-দাওয়া

আজমির শরিফের আশপাশ জুড়ে অসংখ্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে। সাদাভাত, বিরানি, মাছ, মাংস, শাকসবজি সবই পাবেন। ১৫০ থেকে ২০০ রুপিতে থালি প্যাকেজ আছে। এক থালিতে ভাত, ডাল, সবজি, সালাদ থাকে। ২০০ বা ২৫০ রুপির মধ্যে মাছ-মাংসও পাবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর