শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
অনন্য
বোমান ইরানি

সমুচা বিক্রেতা থেকে বলিউড স্টার

শনিবারের সকাল ডেস্ক

সমুচা বিক্রেতা থেকে বলিউড স্টার

বাবার সঙ্গে ভাজাপোড়ার দোকানে কাজ করতেন বোমান ইরানি। সেই আয়ে সংসার চলত না। গেলেন তাজ হোটেলে বয়ের কাজ করতে। কিছুদিন ছবি তুলে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করলেন। তাতেও হলো না ভাগ্য বদল। বন্ধু বলল থিয়েটারে কাজ করবে? ভাগ্য বদল হলো এক ফোনে। বিধু বিনোদ চোপড়া অফিসে ডাকলেন তাকে। নিজে তাকে দুই লাখ রুপির একটা চেক দিলেন, বললেন, ‘সামনের বছরের ডিসেম্বর মাস পুরোটা আপনি আমাকে দেবেন।’ ‘মুন্নাভাই এমবিবিএসে’ অভিনয়ের সুযোগ মিলল তার...

 

৪১ বছর বয়সে মানুষ যখন ক্যারিয়ার গুছিয়ে, মধ্যবয়সের ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন ব্যতিক্রম বোমান ইরানি। বলিউডের অভিনেতা বলেই চেনে সবাই। কজন জানে তিনি একজন দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার, দারুণ কণ্ঠশিল্পী? অথচ অভিনেতা বলতেই তাকে এক নামে চেনে যাচ্ছে ভক্তরা। মুন্নাভাই এমবিবিএস আর ডন থ্রি-তে কাজ করে বলিউডের আলো তার ওপর টেনে নিয়ে আসেন। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানেই তিনি পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে। থ্রি ইডিয়টসের প্রফেসরের ভূমিকার অভিনয় করে তো সবাইকে চমকে দিয়েছেন। এখন পুরোদস্তুর অভিনেতা হলেও তার কিন্তু অভিনেতা হওয়ার কথা ছিল না। তার জীবনের গল্পটা মোটেই রুপালি পর্দায় দেখানো জমকালো নয়। তার জন্মের ছয় মাস আগেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা দিল আরেক বিপদ। তার তোতলামো স্বভাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল স্বজনরা। লোকজন তার দিকে কীভাবে যেন তাকায়! এ কারণে কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন। শৈশবের এই পাগলামো কিন্তু মোটেই হেলাফেলা করার মতো ছিল না। স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে কিছুই বলতে পারলেন না।  বিভিন্ন ছবি দেখিয়ে শিক্ষকরা জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী, মাছ-গরু-ঘোড়া? ভয়ে তিনি একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না সেখানে। তার ভয়, তোতলামো ধরা পড়ে যাবে তখন আর স্কুলে ভর্তি হতে পারবেন না। এসব কিন্তু মোটেই তার ওপর বিপদ ডেকে আনল না। স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছিলেন তিনি।  স্কুলে তার কোনো বন্ধু ছিল না। কথা বললেই সহপাঠীরা হাসত বলে সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। কারও সঙ্গে মিশতে ভয় পেতেন তিনি। স্কুল জীবনটা তাই সাদামাটাই কাটল। স্কুল থেকে পাস করার পর কেমন জানি সব গোলমেটে হয়ে গেল। পড়াশোনা ছেড়ে বাইরে কাজ করতেই তার আগ্রহ। তার বাবা বোম্বের গ্রান্ট রোডে একটা দোকান চালাতেন। খুবই ছোট একটি দোকান। সেখানে ভাজাপোড়া বিক্রি হতো। মানুষজন ভালোই ভিড় করত। সমুচা বিক্রিতে মগ্ন হয়ে গেলের বোমান। আলুর ওয়েফার আরও কয়েক রকমের নাশতাজাতীয় খাবারের চাহিদা মেটাতে বাবার সঙ্গে কাজে লেগে থাকেন। বাবার সঙ্গে শিঙ্গাড়া-সমুচার ব্যবসায় হঠাৎই ভাঙন এলো। বাবার মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেল সব। বাবা মারা গিয়ে তার মাথার ওপর রেখে গেলেন দেনার ভার। কাজ বন্ধ করার উপায় নেই। তার সঙ্গে দোকানে হাত খাটাতে লাগলেন তার মা। দিনরাত ভাজাপোড়ার দোকানে মায়ের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। দেনা শোধ করার জন্য এরচেয়ে ভালো কাজ তার আর জানা নেই। তবে তার মা কখনোই টাকা-পয়সার দৈন্যতা বুঝতে দিতে চাইতেন না। কাজ শেষে সময় পেলেই তাকে নিয়ে ছুটতেন সিনেমা হলে। বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই ‘আলেকজান্ডার থিয়েটার’ নামে একটা সিনেমা হল ছিল। মাঝে মাঝে সেখানেই রুপালি পর্দায় মানুষের অভিনয়ে বুঁদ হয়ে থাকতেন বোমান ইরানি। এমনও হয়েছে, মায়ের কাছ থেকে টাকা পেয়ে এক সিনেমা তিন চারবার দেখে এসেছেন। সিনেমার প্রতি এই আগ্রহ তৈরিতে তার মায়ের ভূমিকাই ছিল প্রধান। সিনেমার গল্প, অভিনয় সব কিছু নিয়েই মায়ের প্রশ্ন থাকত। বোমান সব খুঁটিয়ে খুুঁটিয়ে মাকে বলতেন। তবে শুধু সিনেমা দেখে তো পেট চলে না। সমুচার দোকানের বিক্রিও কমে গেল। বোমান ঠিক করলেন কোনো একটা বারে কাজ করলে কেমন হয়? এ জন্য দুই বছরের একটা ওয়েটার কোর্সও করে নিলেন। টাকা উপার্জনের ক্ষুধা তাকে পেয়ে বসেছিল। বোম্বের বিখ্যাত ‘তাজ হোটেলে’ গেলেন তিনি। কাজও পেলেন। শুরুর দিকে রুম সার্ভিসের কাজ দেওয়া হলো তাকে। লোকজনের ট্রলি নিয়ে রুমে পৌঁছে দিতেন, চা-কফি দিয়ে আসতেন, বিছানাপত্তর পরিষ্কার করতেন। হোটেলে কাজ করে ভাগ্য বদল হয়নি তার। তবে বকশিশ জিনিসটা তাকে বেশ চমকে দিয়েছিল। একবার এক অতিথি যাওয়ার সময় তাকে পাঁচ রুপি বকশিশ দিয়েছিল। এই টাকা দিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতেই পারছিলেন না তিনি, ফোন দিয়ে বসলেন মাকে। আনন্দ-বেদনার জীবন ছিল না। তাজ হোটেলে দুই বছর কাজ করেছিলেন তিনি। হঠাৎই এলো দুঃসংবাদ। বোমানের মা এক্সিডেন্ট করলেন। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেন না। ভাজাপোড়ার দোকান সামলানোর লোকও নেই। খবর পেয়ে আর দেরি করলেন না বোমান। তাজ হোটেলের কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরে এলেন। ভাজাপোড়ার দোকানই চালাতে থাকলেন। প্রচণ্ড গরমে ঘাম ঝরাতে ঝরাতে কড়াইতে তেল  ঢেলে আলুর ওয়েফার ভাজতেন তিনি। নিজেই রাঁধুনি, নিজেই ক্যাশিয়ার, নিজেই ওয়েটার। প্রায় দশ বছর ওই দোকাই চালিয়েছিলেন তিনি। বিয়ে করলেন, বয়স ত্রিশ পেরোতেই সন্তানের বাবা হয়ে গেলেন। ভাজাপোড়ার দোকানের আয় থেকেই টাকা জমিয়ে একটা ক্যামেরা কিনেছিলেন। ছবি তোলার গল্প শুরু তার। বিভিন্ন স্কুলে অনুষ্ঠানগুলোতে ছবি তুলে পঁচিশ-ত্রিশ রুপি করে উপার্জন হতো তার। আর্থিক দৈন্যতা কাটাতে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেন তিনি। ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসল মুম্বাইতে। সেখানে ছবি তোলার সুযোগ পেলেন না। অনেক অনুরোধের পরে স্থানীয় একটা টুর্মামেন্ট কাভারের দায়িত্ব দেওয়া হলো তাকে। সেটা সফলভাবে শেষ করায় সভাপতি তাকে খুশি হয়েই ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের অ্যাক্রিডেশন কার্ড দিলেন! সেই টুর্নামেন্টে তিনটে ছবি নরওয়ের একটা ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করে নয়শ ডলার পেয়েছিলেন তিনি! এরমধ্যে এক বন্ধু তাকে প্রস্তাব দিলেন থিয়েটারে অভিনয়ের। থিয়েটারের দলে যোগ দিতে হলে আগে অডিশন দিতে হয়। সেখানে প্রথম দফাতেই তাকে বাদ  দেওয়া হলো। তবে দ্বিতীয়বার অডিশনে টিকে  গেলেন। নাটকটা দর্শকপ্রিয়তা পেল। বোমানও জনপ্রিয় হলেন খানিকটা। তার ভাগ্য বদল হলো এক ফোনে। তাকে বলা হলো প্রযোজক বিধু বিনোদ চোপড়ার অফিসে যেতে। বিধু বিনোদ  চোপড়া নিজে তাকে দুই লাখ রুপির একটা চেক দিলেন, বললেন, সামনের বছরের ডিসেম্বর মাস পুরোটা আপনি আমাকে দেবেন। বোমান জিজ্ঞেস করলেন, কোনো সিনেমার জন্য? বিধু বললেন, আমার হাতে কোনো সিনেমা নেই আপাতত। আমি আপনার কাজ দেখেছি, তাই আগেভাগে শিডিউল নিয়ে রাখলাম।’ ছয় মাস পরে বিধু আবার ফোন করলেন। ডাক পড়ল, মুন্নাভাই এমবিবিএস! শুরুতে কিন্তু এই সিনেমায় কাজ করতে চাননি বোমান ইরানি অথচ ওই একটা সিনেমা দিয়েই তিনি সুপার হিট হয়ে গেলেন। ৪১ বছর বয়সে এসে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। এরপর ম্যায় হু না, ডন,  দোস্তানা, হেই বেবি— একের পর এক সিনেমায় তিনি ছিলেন চোখে পড়ার মতো। ‘থ্রি ইডিয়টস’ দিয়ে তিনি সব জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ছাড়িয়ে গেলেন। বোমানের নানী তাকে বলতেন, রাস্তার মুচিও যদি হতে হয়, সেরা মুচিটাই হবে। বোমানও সেটাই মাথায় রেখেছেন সবসময়।

সর্বশেষ খবর