শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফেসবুক থেকে মানব সেবায়

রফিকুল ইসলাম রনি

ফেসবুক থেকে মানব সেবায়

অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, ক্যান্সার রোগী,  প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য সহায়তা চাওয়া হয়। কারও টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না, কারও একটি হুইলচেয়ার বা একটি রিকশা, ঘর বা দোকান করে দিলেই স্বাবলম্বী হয়— সেসব ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান মামুন। দুই বছরে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছে দুই শতাধিক অসহায়-দরিদ্র মানুষ

 

‘২৬ বছর বয়সী আনোয়ারার মুখে বিশাল আকৃতির টিউমার। মুখ বিকৃতি হয়ে যায়, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। স্বামীও এই অবস্থা দেখে ডিভোর্স দেয়। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য নেই অসহায় মা-বাবার। খবর পেয়ে আনোয়ারার বাড়ি যান যুবক মামুন বিশ্বাস। আনোয়ার অসহায়ত্বের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানান। সহৃদয়বানরা সাড়া দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচিব আনোয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। মিরপুর ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে আনোয়ারার ভর্তির পর অস্ত্রোপচার করা হয়। মুখ থেকে বের করা হয় কেজি টিউমার। আনোয়ারা এখন সাধারণ জীবন যাপন করছেন। সরকারিভাবে অস্ত্রোপচার করা হয়। খরচ হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা। চিকিৎসার সব টাকাই মামুন ফেসবুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন।’ এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক  ব্যবহার করে অসহায় ও প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ৩০ বছর বয়সী মামুন বিশ্বাস। 

সাত বছর বয়সী ফাতেমার পেটে বিশাল আকৃতির টিউমার। পানি জমে বেঢপ। শিশুটির নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য নেই অসহায় মা-বাবার। মামুন এগিয়ে আসেন, ফেসবুকে জানান সব। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফাতেমাকে ভর্তির পর অস্ত্রোপচার করা হয়। বের করা হয় টিউমার ও জমে থাকা পানি। ফাতেমা এখন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। অস্ত্রোপচারে খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা। চিকিৎসার সব টাকাই মামুন ফেসবুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন।

শাহজাদপুর কাদাই বাদলা গ্রামের শাহাদত হোসেনের চোখসহ সারা শরীরের ছিল অসংখ্য মাংসপিণ্ড। চোখে দেখতে না পারায় কাজকর্ম করতে পারত না। বিষয়টি জানার পর মামুন বিশ্বাস তার বাড়িতে গিয়ে ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করে ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন এবং সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি কামনা করেন। ফেসবুকের মাধ্যমে সহায়তা পান এক লাখ আট হাজার টাকা। পরে প্রশাসনের মাধ্যমে শাহাদতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি জেলা প্রশাসক ও সিভিলসার্জনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শাহাদতের পাশে দাঁড়ান। একইভাবে বেলকুচির সাত মাস বয়সী হিমুর হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র ছিল। ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৫ টাকা সহায়তা পাওয়া যায়। ঢাকার মিরপুর   ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় হিমু। হিমুর চিকিৎসায় খরচ হয় ৮৫ হাজার টাকা। বাকি দেড় লাখ টাকা হিমুর মায়ের নামে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়া হয়। একইভাবে মামুন বিশ্বাস ফেসবুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থ দিয়ে দরিদ্র শীতার্তদের মধ্যে দরিদ্র এক হাজার পিস কম্বল, বেলকুচির হার্ট ছিদ্র মোস্তাকিমের চিকিৎসার জন্য ২ লাখ টাকা, শাহজাদপুর বেলতৈল ইউপির মালিডাঙ্গা গ্রামের সামাদ ফকিরকে ৪১ হাজার টাকা দিয়ে ঘর নির্মাণ, বেলকুচির গয়নাকান্দি গ্রামের মানসিক রোগী আবু বকরকে ৫১ হাজার টাকা দিয়ে ঘর নির্মাণ, শাহজাদপুরের উল্টাডাব গ্রামের শত বছরের বৃদ্ধা পিপড়ি বেওয়াকে চিকিৎসা সেবার জন্য ৩২ হাজার টাকা অনুদান, উল্লাপাড়ার মেধাবী ছাত্র ভ্যান চালক শাহিনকে ৪১ হাজার টাকা বৃত্তিপ্রদান, যশোরের লেবুতলা গ্রামের বয়োবৃদ্ধা কালিদাসকে ১৭ হাজার টাকা চিকিৎসাসেবা বাবদ অনুদান, শাহজাদপুরের বিভিন্ন গ্রামের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেব ও বিশুদ্ধ পানির জন্য ৬০টি টিউবওয়েল ও পাঁচটি পাকা টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। অসহায় মুক্তিযোদ্ধা, ক্যান্সার রোগী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য সহায়তা চাওয়া হয়। কারও টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না, কারও একটি হুইলচেয়ার বা একটি রিকশা, ঘর বা দোকান করে দিলেই স্বাবলম্বী হয় সেই সব ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান তিনি। দুই বছরে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছে দুই শতাধিক অসহায়-দরিদ্র মানুষ।

ফেসবুকের মাধ্যমে কাজটা কীভাবে হয়? মামুন বলেন, ‘সমাজে প্রচুর ভালো মানুষ আছেন, কিন্তু মানুষ আস্থা পায় না বলেই সহায়তা করতে চান না।’ ফেসবুকের ইনবক্সে যে ব্যক্তির সহায়তা প্রয়োজন, সেই ব্যক্তি নিজে বা অন্যরা মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর মামুন নিজে যান বা অন্য এলাকার হলে ফেসবুকের বন্ধুদের ঘটনা সত্য কি না, তা জানার জন্য পাঠান। সব তথ্য সত্য মনে হলে তখন মামুন ছবিসহ ফেসবুকে সহায়তা চেয়ে পোস্ট দেন। টাকা সংগ্রহের টার্গেট যখন পূরণ হয়, তখনই তা ফেসবুকে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যে এই লোকের আর টাকার প্রয়োজন নেই। সবশেষে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে যে ব্যক্তির জন্য যখন যে সহায়তা পাওয়া যায়, তার হাতে টাকা  বা বস্ত্র সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়, যাতে কারও মনে কোনো সংশয় না থাকে।

ফেসবুকের মাধ্যমে মানবসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মামুন। স্ত্রী আছিয়া  বেগম ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে, বাবা ও ভাই-বোন নিয়েই মামুনের সংসার। বাবা আলহাজ ডা. মো.মাহবুবুল হোসেন শিক্ষক ও ভাই মুক্তা বিশ্বাসের সঙ্গে বিজনেস করেন মামুন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের আগুনকালি গ্রামে তাঁর বসবাস। শুধু মানুষ নয়, পশু-পাখির জন্যও মন কাঁদে মামুনের। ২০১৩ সাল থেকে নিজের গ্রামে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কাজে লেগে আছেন। স্বাস্থ্য সচিবের পি.এস.টু.আই সেক্রেটারি শামীম আহমেদ জানান, সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে ভাবে মামুন বিশ্বাস ফেসবুক দিয়ে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করছে, আমি মনে করি সারা দেশে রোল মডেল হবে মামুন বিশ্বাস। জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকা জানান, প্রশাসনের চোখ যেখানে সহজে পৌঁছে না অর্থাৎ সমাজের সবচেয়ে নিম্নবিত্তদের সহযোগিতা করছেন মামুন বিশ্বাস।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর