শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
সাংহাই টাওয়ার

এক অপার বিস্ময়ের নাম

জিন্নাতুন নূর, চীন (সাংহাই) থেকে ফিরে

এক অপার বিস্ময়ের নাম

চীনের ব্যস্ততম শহর সাংহাইয়ের পুডং এলাকায় গিয়ে এবার একসঙ্গে অনেকগুলো আকাশছোঁয়া ভবন নজর কাড়ে। গত ৭ জুলাই চীনের সবচেয়ে বড় এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২য় সর্বোচ্চ আকাশছোঁয়া ভবনটি দেখতে পুডং এলাকায় যাই। আর সেখানে গিয়ে আকাশছোঁয়া ভবন বলতে আসলে যা বোঝায় দুই চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে সেটিই প্রত্যক্ষ করি। আকাশ সেদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকায় মেঘগুলো নিচে নেমে এসেছিল। আর এতে সাংহাই টাওয়ারের অনেকটা অংশ ঢাকা পড়েছিল মেঘে। সাংহাই টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থানের পরও একটি ভবন আকাশের মেঘে ঢাকা পড়েছে! আর এমন শুধু সত্যিকারের আকাশছোঁয়া উঁচু ভবন হলেই সম্ভব। চিন্তা করছিলাম বাইরে থেকে যে ভবন দেখে চমকে উঠেছি ভিতরে না জানি ভবনটি কত বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছে!

 

সাংহাই টাওয়ারের দৈর্ঘ্য ৬৩২ মিটার (দুই হাজার ৭৩ ফিট। যা ১২৮তলা বিশিষ্ট। ভবনটি জ্বালানি সাশ্রয়ী আর অফিস, বিনোদন ও বাণিজ্যিক দোকানপাটের ব্যবহারের কাজে সাংহাই ভবনটিকে ৯টি আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে আছে মাল্টিফাংশন কনফারেন্স সেন্টার ও মাল্টিফাংশন ব্যানকুয়েট হল। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু অবজারভেশন ডেকও এই টাওয়ারে। এ জন্য পুরো শহরের সুন্দর প্যানারোমিক দৃশ্য দেখতে চাইলে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের যেতে হবে সাংহাই টাওয়ারের অবজারভেশন ডেকে। ডেকটি ১২১ তলায় অবস্থিত। এই ডেক থেকে দর্শনার্থীরা বেইজিং এর হুয়াংপু রিভার, অন্য আকাশছোঁয়া ভবন যেমন— জিন মাও টাওয়ার, ওয়ার্ল্ড ফিনান্সিয়াল সেন্টারসহ শহরের অন্যান্য স্থাপনা দেখারও সুযোগ পাবেন।

 

সাংহাই টাওয়ারে প্রবেশের আগে পর্যটকদের এই ভবনের এক্সিবিশন ফ্লোর, যা বি-ওয়ান এ অবস্থিত সেখানে ভবনটির কাঠামো সম্পর্কে ধারণা দিতে লেজার রশ্মির মাধ্যমে একটি প্রদর্শনী দেখানো হয়। এর পর অত্যন্ত দ্রতগতির এক্সপ্রেস এলিভেটরে করে মাত্র ৫৫ সেকেন্ডের মধ্যেই অভজারবেশন ডেকে পৌঁছে যেতে পারবেন পর্যটকরা। মজার বিষয় হচ্ছে— পর্যটকরা যখন দ্রুতগতির এই লিফটে করে উপরে ওঠেন তখন অত্যধিক দ্রুতগতির জন্য লিফট ব্যবহারকারীদের শরীরের ওপর চাপ পড়ে। এতে অনেকের কান বন্ধ হয়ে যায়, কারও মাথা ঘোরে আবার কারও শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই ভবনের লিফটের গতিও পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। প্রতি সেকেন্ডে যা সাড়ে বিশ মিটার গতিতে চলে। মিটসুবিশি ইলেকট্রিক করপোরেশন এই ভবনের ১৪৯টি এলিভেটর (১০৮টি লিফট ও ৩টি হাই স্পিড লিফট) করেছে। কাচ ও ইস্পাতের তৈরি ভবনটি যত উপরে উঠেছে ততই ক্রিমরোলের মতো টুইস্ট নিয়ে পেঁচিয়ে এক মনোমুগ্ধকর আকৃতি ধারণ করেছে। ভবনটিতে প্রতিদিন ১৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা রয়েছে। এ ছাড়া এই টাওয়ারের বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সক্ষমতাও আছে। ভবনটির ৮৪ তলায় আছে ২৫৮ রুমের সাংহাই টাওয়ার জি-হোটেল। বলা হয়ে থাকে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু হোটেলও।

 

 

 

এ ছাড়া সাংহাই টাওয়ারের অবজারভেশন ডেকে আছে থ্রিডি প্রযুক্তির মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী। কাচের দেওয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ সেই দেওয়াল সশব্দে ভেঙে পড়বে। এমন উচ্চমানের থ্রিডি শো উপভোগ করতে হলে দর্শনার্থীদের অবশ্যই চীন ভ্রমণে গিয়ে একবারের জন্য হলেও সাংহাই টাওয়ারে ঘুরে আসতে হবে। চীনা দর্শনার্থী ছাড়াও এই সুউচ্চ ভবনটি দেখতে চীনের বাইরে থেকেও বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা ভিড় করেন। আর উঁচু এই ভবনে ওঠার আগে দর্শনার্থীদের প্রত্যেকের আলাদা করে অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলা হয়। দর্শনার্থীরা চাইলে সাংহাই টাওয়ারের পোস্টকার্ড সংবলিত সেই ছবি সুন্দর স্মৃতি হিসেবে অবজারভেশন টাওয়ার থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। যেহেতু সাংহাইয়ে প্রায়ই টাইফুনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় এ জন্য সাংহাই টাওয়ারের মতো আকাশছোঁয়া ভবনের নকশা তৈরির সময় টাইফুনের বিষয়টি মাথায় রেখে ভবন তৈরি করা হয়েছে।

 

 

টাওয়ারের প্রতি তলাতেই বাতাসের ধাক্কা সামলাতে ভবনটি এক ডিগ্রি করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথা হলে জেমস নামের একজন চীনা গাইড বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবকাঠামোর জন্য সাংহাইয়ের অন্য উঁচু দালানকোঠাগুলোর টাইফুনের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও নকশার কারণে সাংহাই টাওয়ারের সেই ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, টাওয়ারটির স্থাপত্য নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, টাইফুনের মতো শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এর ক্ষতির আশঙ্কা কম।

 

 

ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ডিজাইন ফার্ম জেন্সলার টাওয়ারটির নকশা করেন। তবে চীনা স্থপতি জুন জিয়া নকশাবিদদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আর এর মালিকানা রয়েছে সাংহাই সিটি গভর্নমেন্টের কাছে। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৮-এর নভেম্বরে এবং ২০১৪ সালের নভেম্বরে তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। যদিও ভবনটির অবজারভেশন ডেক পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৬-এর জুলাই মাসে উন্মুক্ত করা হয়। আর ২০১৭-এর ২৬ এপ্রিল থেকে ১১৮ তলাটি সাইটসিয়িং ডেক হিসেবে মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ভবনের স্থায়িত্বশীল নকশার জন্য এটি চায়না গ্রিন ব্লিডিং কমিটি এবং ইউএস গ্রিন ব্লিডিং কাউন্সিলের সনদ পেয়েছে। এই টাওয়ারে ৬০টির অধিক কোম্পানি রয়েছে। যার মধ্যে আছে চীনের বৃহৎ কোম্পানি আলিবাবা গ্রুপের এন্ট ফিনান্সিয়ালের অফিসও। স্থপতিদের মতে, এই ধরনের সৃজনশীল ভবনগুলোকে শুধু উঁচু ভবন হিসেবে নয়, এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে তা আকশছোঁয়া বাগানে পরিণত হয়। বলা যেতে পারে, আকাশছোঁয়া কোনো টাওয়ারে একই সঙ্গে বসবাস ও কাজ করার জন্য সাংহাই টাওয়ার বিশ্ববাসীর কাছে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে।

 

 

 

চীনের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল্ডিং...

৬৩২ মিটার

সাংহাই টাওয়ার; জিন মাও টাওয়ার ও সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যানশিয়াল সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। এটাই বিশ্বের প্রথম বিস্ময় যেখানে তিনটি বিল্ডিং পাশাপাশি অবস্থিত।

 

টাওয়ারের এলিভেটরের স্পিড প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮ মিটার।

 

এর ৮৪ তলা ও ১১০ তলায় রয়েছে ৬ তারকা জে-হোটেল। এটা এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় হোটেল।

 

কোন ফ্লোরে কী?

♦ আর্থিক প্রতিষ্ঠান : ৮, ১৭, ১৮ এবং ১৯তম তলা।

♦  আইনি অফিস : ৮, ৯, ১১ এবং ১২তম তলা।

♦  ডেন্টোস :১৫ এবং ১৬তম তলা।

♦  ফিচ রেটিং : ৩৪তম তলা।

♦ এল’লয়েড’স : ৩০তম তলা।

♦ তিব্বত ট্রাস্ট করপোরেশন : ৫৭তম তলা।

♦  গুহুয়া লাইফ ইন্স্যুরেন্স : ৩২তম তলা।

♦  হেইলান গ্রুপ : ৬০তম তলা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর