মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন লুসি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে মানবসেবা করতে চান। মৃত্যুর পরও সমাহিত হতে চান বাংলাদেশে। সরকারের দেওয়া নাগরিকত্ব পেয়ে দারুণ উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত লুসি। এতে তার শেষ স্বপ্ন পূরণ হলো।
পরিবার-পরিজন ছেড়ে ৫৭ বছর আগে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে মানবসেবা করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে জন্মগ্রহণকারী লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হোল্ট। ১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষানবিস সিস্টার হিসেবে। পরে যশোর ফাতেমা হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন কিছু দিন। ওই সময় লুসি বুঝলেন, মিশনের সিস্টার হয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট গণ্ডির কিছু মানুষকে হয়তো সেবা দিতে পারবেন, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুই করার সুযোগ থাকবে না তার। তাই মিশনের সিস্টারের দায়িত্ব ছেড়ে সুবিধাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন লুসি। ৪৪ বছরের কর্মজীবন থেকে ২০০৪ সালে অবসরে যান তিনি। এরপর থেকে বই লিখে, অনুবাদ করে, অসহায় দুস্থ শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে ব্রিটেনে অবস্থানরত বন্ধু-স্বজনদের কাছে চিঠি লিখে তহবিল গঠন এবং আগ্রহীদের ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলার চেষ্টা করছেন কুমারী লুসি। মাতৃভূমি এবং সংসারের মোহ ত্যাগ করে মানবসেবার ব্রত নিয়ে লাল সবুজের দেশেই থেকে যান তিনি। শুধু তাই নয়, সহজ-সরল মানুষের ভালোবাসা এবং আতিথেয়তায় আপ্লুত লুসি বাংলাদেশের নাগরিক হয়েই সমাহিত হতে চান এ দেশের মাটিতে। সেই ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে এতদিন তাকে প্রতিবছর ৩৮ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশি ভিসা নবায়ন করতে হয়েছে। লুসির এমন বাংলাদেশ প্রেম এবং নিজের জীবনের মহামূল্যবান সময় বিলিয়ে দেওয়াকে মূল্যায়িত করেছে দেশের সরকার। বরিশালের গণমাধ্যম এবং জেলা প্রশাসনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথমে ফি মওকুফসহ লুসিকে ১৫ বছরের আগাম মাল্টিপল ভিসা দেয় বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সেই ভিসা (ফি মওকুফসহ) যখন তার হাতে তখন এলো আরও একটি সুসংবাদ। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে লুসিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে লুসিকে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া দ্বৈত নাগরিকত্বের চিঠি লুসি হোল্টের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক।
১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে বাবা জন হোল্ট এবং মা ফ্রান্সিস গ্রেস দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হোল্ট। দুই বোনের মধ্যে বড় বোন রুথ ফেলটন এবং লুসি ছোট। ছোটবেলা থেকেই সিস্টার (ধর্মীয় সেবক) হওয়ার স্বপ্ন ছিল লুসির। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে সেবিকা থাকাকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও সেবা করেন লুসি। ওই সময় ব্রিটেনে মায়ের কাছে চিঠি লিখে লুসি জানিয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বাধীন হতে চাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন যোগ্য নেতা পেয়েছেন। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ চায় না’- এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন লুসি। মায়ের মৃত্যুর পর চিঠিটি আবার লুসির কাছে ফেরত পাঠায় তার বড় বোন রুথ ফেলটন।
লুসি বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর সহধর্মিণী। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি উপহার পাঠিয়েছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছাকে। এর জবাবে ১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার নিজের হাতের লেখা একটি ধন্যবাদপত্র পেয়েছিলেন লুসি।
বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে লুসির দেখভাল করা ঊষা দাস বলেন, লুসি একজন উঁচু মনের মানুষ। তার মধ্যে কোনো লোভ-লালসা নেই। তিনি এই দেশের মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এ কারণে এ দেশেই থেকে গেছেন। ঊষা বলেন, লুসি মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে মানবসেবা করতে চান। মৃত্যুর পরও তিনি সমাহিত হতে চান বাংলাদেশে। সরকারের দেওয়া নাগরিকত্ব পেয়ে দারুণ উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত লুসি। এতে তার শেষ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।