শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বলিউডে আরশাদ ওয়ার্সির অবিশ্বাস্য উত্থান

সাইফ ইমন

বলিউডে আরশাদ ওয়ার্সির অবিশ্বাস্য উত্থান

তিনি বড় হয়েছেন একেবারে একা। বাবা মারা যাওয়ার পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বোর্ডিং স্কুলের অন্য ছেলেরা যখন পরিবার থেকে চিঠি পেত, নানা রকম সামগ্রী পেত তিনি তখন এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেন। এমনকি কর্মজীবনের  শুরুতে রাস্তায় রাস্তায় প্রসাধনীও ফেরি করেছেন। তিনি বর্তমানে বলিউডের সফল  অভিনেতা আরশাদ ওয়ার্সি—

 

সফল মানুষ বলতে আমরা আসলে কি বুঝি! যার অনেক অর্থবিত্ত আছে তিনি সফল নাকি যে মানুষটি তার শিল্প সত্তা দিয়ে কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন তিনি! এই নিয়ে একটা বিতর্ক চলে প্রায় সবখানেই। আর যারা দুটি ক্ষেত্রেই সফল তাদের আমরা নিঃসন্দেহে সফল মানুষ বলতেই পারি। এমনই একজন সফল মানুষ বলিউড অভিনেতা আরশাদ ওয়ার্সি। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি সার্কিট। করেছেন ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’, ‘ইশকিয়া’ ও ‘জলি এলএলবি’র মতো চলচ্চিত্র। প্রতিটা সফল মানুষের পেছনে থাকে সংগ্রামের কঠিন ইতিহাস। কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল বলিউডের জনপ্রিয় এই অভিনেতাকেও। আরশাদ ওয়ার্সিকে সম্প্রতি নিজেই তার সংগ্রামের কথা জানিয়েছেন। একসময় তার হাতে  কোনো ছবি ছিল না। মুন্নাভাই এমবিবিএস-এর আগে পুরো কর্মহীন ছিলেন আরশাদ ওয়ার্সি! ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ও ‘সেহর’ ছবির আগে প্রায় ৩ বছর কর্মহীন ছিলেন তিনি। সংসার চলছিল স্ত্রী মারিয়া গোরেত্তি উপার্জনে। গোরেত্তি তখন চাকরি করতেন। ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয় আরশাদের। তার অভিনয় সব জায়গায় প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু তারপর দুতিনটি ছবি পরপর ফ্লপ হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রি থেকে কার্যত হারিয়ে যান তিনি। প্রায় ৩ বছর হাতে কোনো কাজ ছিল না। উপার্জনের জন্য ছোটখাটো নানা কাজ করতেও বাধ্য হন সে সময়। তারপর তার হাতে আসে ‘অ্যায়সা ভি হোতা হ্যায়’, ‘সেহর’ এর মতো চলচ্চিত্র। তারপরই আসে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্র ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’। লোকের মুখে মুখে উঠে আসে সার্কিটের নাম। আরশাদ ওয়ার্সি বলেন, ‘নিজের কাজ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি তা জানা থাকে, তবে আজ বাদে কাল মানুষ স্বীকৃতি  দেবেই। আমি কখনোই নিজের প্রতিভার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাইনি। পিছনে বড় নাম থাকার সুবাদে যে সব অভিনেতা প্রতিভা ছাড়াই চলচ্চিত্রের জগতে এসেছেন তাদের জন্য খারাপ লাগে তার। কারণ নিজের যেখানে যোগ্যতা নেই, সেই জগতে  জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে নিজেদেরই বোকা বানান তারা। তাদের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, তারপর লোকে বুঝতে পারে, তারা একেবারেই অভিনয় ক্ষমতাহীন। এই ধরনের অভিনেতাদের ভয় পাওয়া উচিত।’ আরশাদ ওয়ার্সি কখনো ভয় পাননি কারণ প্রথম ছবিতেই বুঝতে পারেন অভিনয় তার কাছে জলের মতো। তিনি এটা করতে পারবেন। জনপ্রিয় সার্কিট চরিত্রটি নিয়ে আরশাদ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, চরিত্রটায় কিছু নেই, একটা সাধারণ গুণ্ডা ছাড়া সে কিছু নয়। মুন্নাভাইয়ের আশপাশে ঘোরা আর পাঁচটা গুণ্ডার মতোই, শুধু তাদের থেকে তার ডায়লগ কয়েকটা বেশি। কিন্তু ক্ষমতা থাকলে সেই চরিত্রেই আপনি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। যদি তা না থাকত, তবে লোকে কবেই ভুলে যেত সার্কিটকে! ‘ভাই টেনশন নেহি লেনেকা ভাই’ এই ডায়লগটা এখনো মানুষের মুখে মুখে ঘুরে।’ মুম্বাইয়ের একটা মুসলমান পরিবারে আরশাদ ওয়ার্সির জন্ম। শৈশবেই বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্বামীর শোকে মাও প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তার বয়স তখন মাত্র চৌদ্দ বছর। বোর্ডিং স্কুলে সব ছেলের বাবা-মা আসে। সপ্তাহে সপ্তাহে ওদের নামে চিঠি আসে। কিন্তু আরশাদের কাছে কেউ চিঠি লেখে না। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো সে। একাকীত্ব ব্যাপারটা তাকে একেবারে ঘিরে ফেলেছিল। নিজেকেই নিজে চিঠি লিখতেন তিনি। তারপর কোনো বন্ধুকে দিয়ে চিঠিটা তার নাম আর স্কুলের ঠিকানায় পোস্ট করে দিত। এভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন আরশাদ। স্কুলের বোর্ডিংয়ের খরচ চালানোর মতো অবস্থাও ছিল না। পৈত্রিক বাড়িটা কিছু লোক ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দখল করে নিয়েছিল। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। ফিল্ম সিটি মুম্বাইতে তখন দুটো কাজে বেশ পয়সা আয় করা যায়। এক আন্ডারওয়ার্ল্ডের গুণ্ডা হয়ে যাওয়া আর দ্বিতীয়টি হলো চলচ্চিত্র জগতে চলে আসা। আরশাদের তখন টাকার ভীষণ দরকার মায়ের চিকিৎসার জন্য। কিছু একটা করতেই হবে!  বেঁচে থাকার তাগিদে মুম্বাইয়ের রাস্তায় রাস্তায় লিপস্টিক আর নেইল পলিশ বিক্রি করতেন তিনি। দুই বছর রোগে ভুগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আরশাদের মা। আপন বলতে ছোট ভাইটা ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ রইল না তার। বলিউডের সঙ্গে যোগসূত্রটা তৈরি হয় ১৯৮৭ সালে। একটা ফটো ল্যাবে পার্টটাইম কাজ পেয়েছিলেন আরশাদ ওয়ার্সি। সেখান থেকে ছবি নিয়ে যেতেন মহেশ ভাটের অফিসে। অনেক অনুরোধ করে একসময় মহেশ ভাটের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাশ’ আর ‘ঠিকানা’ সিনেমা দুটোয় অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন তিনি। নাচের প্রতি আগ্রহ থেকে আকবর সামীর নাট্যদলে ভর্তি হয়েছিলেন।  সেই দলের হয়েই ১৯৯১ সালে অংশগ্রহণ করেন ইন্ডিয়ান্স ড্যান্স চ্যাম্পিয়নশিপে। চ্যাম্পিয়নও হয়ে যান সেই প্রতিযোগিতায়। অমিতাভ বচ্চনের স্ত্রী জয়া বচ্চনই আরশাদকে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন সিনেমায় অভিনয়ের। অমিতাভ বচ্চনের প্রোডাকশন হাউসের প্রথম সিনেমা ছিল ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’ নামের চলচ্চিত্রটি। সেখানেই অভিনেতা হিসেবে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের জন্য দারুণ প্রশংসা পেয়ে ভেবেছিলেন সংগ্রামের দিন বুঝি শেষ হয়েছে। আসলে হয়েছে উল্টো। আসল সংগ্রামের শুরু হয়েছিল তার পরই যা শুরুতেই বলা হয়েছে। দর্শকরা আরশাদ ওয়ার্সিকে ভালোবেসেছেন। ওই এক সার্কিটের চরিত্র দিয়েই মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন আরশাদ ওয়ার্সি।

সর্বশেষ খবর