শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভরতনাট্যমে অনন্য আমাদের অর্থী

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ভরতনাট্যমে অনন্য আমাদের অর্থী

সূর্যের শেষ লালিমাটুকু শুষে নিয়ে আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে বেলা। সাঝবাতির উজ্জ্বল আলোয় সবার অপলক দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। হঠাৎ কানে ভেসে এলো তালে তালে হেঁটে চলা ঘুঙুরের আওয়াজ। মঞ্চে উঠতেই শুরু হলো ক্যারিশমা। মুখশ্রীতে কখনো ফুটে উঠছে দেবী দুর্গার শক্তির আলোড়ন, হাতের কারুকাজে সরস্বতী স্মরণ আবার তাতেই পূর্ণতা পাচ্ছে লক্ষ্মীর আবাহন। ভরতনাট্যমের ‘ত্রিমাতা কউত্তভাম’ এর কারুকাজে মঞ্চের সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নিলেন অর্থী আহমেদ। দিল্লির পার্ক ইন হোটেলে উপস্থিত দর্শক সারি থেকে ভেসে এলো জোর করতালি, বাহবা আর স্তুতি।   

প্রশংসায় ভাসালেন ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শিল্পীরাও। বাংলাদেশ-ভারত সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে ভারত সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশি ১০০ তরুণ। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের আয়োজনে এই ডেলিগেশন টিমে শিল্পী, শিক্ষার্থী, গণমাধ্যমকর্মীসহ ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। বাংলাদেশ টিমের পক্ষ থেকে ছিল অর্থীর জাদুকরী ওই পারফরমেন্স।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতের যুব বিভাগের সচিব ড. এ কে দুবেসহ অন্য অতিথিরা বলছিলেন ভরতনাট্যমের এই উপস্থাপন একদিনের নয়। আজকের এই অসাধারণ পারফরমেন্স দীর্ঘদিনের সাধনার ফল। তখনই ভাবলাম মেয়েটার সঙ্গে একটু পরিচিত হতে হবে। সমস্যা হলো মঞ্চের অর্থি আহমেদকে তো চিনি কিন্তু ভরতনাট্যমের কস্টিউমের বাইরের অর্থিকে তো চিনি না। ১০০ জনের গণ্ডির মধ্যে খুঁজতে বেশি বেগ পেতে হলো না। খুঁজে পেলাম হাসিখুশি বন্ধুবৎসল নতুন এক অর্থিকে।

ঢাকায় ফিরে শুনতে চাইলাম ভরতনাট্যম সাধনার গল্প। খুলে বসলো গল্পের ঝুড়ি। স্মৃতির পাতা উল্টাতেই ফিরে যেতে হলো অর্থীর শৈশবে। চার বছর বয়স থেকে নাচের স্কুলে যাতায়াত শুরু। বাড়ির পথ চেনার আগেই নাচের তাল লয় চিনেছেন তিনি। কিন্তু নাচের এত শাখা-প্রশাখা থাকতে ভরতনাট্যম কেন? জানতে চাইলে উত্তর এলো, আপনার এই প্রশ্নটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কারণ সবাই আমাকে এটা জিজ্ঞেস করে। ‘ছায়ানটে মণিপুরী-ভরতনাট্যম বেছে নেওয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে। তখনই ভরতনাট্যম নিই। আসলে ভরতনাট্যমের প্রতি আমার অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে।’ ভালো লাগা থেকেই এ বিষয়ে পড়াশোনা? জানতে চাইলে বলেন, ‘একদমই তাই। একসময় মনে হলো, নাচটাই যখন করছি তাহলে পড়াশোনা কেন নাচে নয়। সেই ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হওয়া। ইন্ডিয়া তে আইসিসি আর এর স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করি।

কথার রেষ না কাটতেই বলেন. ‘আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আসলে নাচ-গান নিয়ে পড়াশোনা করাটা এখনো পরিচিতি পায়নি। তাই আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। সম্প্রতি ভরতনাট্যম নিয়ে চেন্নাইয়ের তামিল ইউনিভার্সিটিতে ডিপ্লোমা টিচার্স ট্রেনিং শেষ করেছি। বাংলাদেশে এবারই প্রথম কেউ এ ডিগ্রি অর্জন করল।

এর আগে টিচার্স ট্রেনিং এ অন্য কেউ আগ্রহী না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থি বলেন, অনেকেই নাচে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য। যেহেতু টিচার্স ট্রেনিং ডিগ্রি চাকরির বাজারে এখনো জনপ্রিয় হয়নি তাই সবার আগ্রহ একটু কম। কিন্তু কেউ যদি নাচকে আত্মস্থ করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায় তাহলে এই ট্রেনিং তার জন্য ফলপ্রসূ হবে। 

নাচ কি এখনো শুধুই নেশা নাকি পেশা হিসেবেও বেছে নিচ্ছেন শিল্পীরা? প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই লুফে নিলেন অর্থী। বললেন, এ প্রশ্নটা শিল্পীদের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নৃত্যশিল্পীরা সব সময়ই গরিব। কারণ নাচ করে অর্থ উপার্জনের বিষয়টা খুব সাময়িক। যখন প্রোগ্রাম চলছে তখন সচ্ছলতা। কিন্তু সারাবছর তো আর প্রোগ্রাম থাকে না। তাহলে যার অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই সে কী করবে। এজন্য সরকারিভাবে প্রণোদনা অথবা সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসরটাকে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। আমরা যারা নাচ করছি সেটা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সাধনাকে টিকিয়ে রাখতে। আমার গুরুদের কাছ থেকে শেখা বিদ্যাটাকে প্রতিনিয়ত ঝালাই করে চলছি।

নৃত্যশিল্পী অর্থির ভরতনাট্যম শেখা শুরু ছায়ানটে বেলায়েত হোসেন খানের কাছে। কোলকাতার রবীন্দ্র ভারতীতে অনার্সে গুরু ছিলেন মিলন অধিকারী আর মাস্টার্সে শ্রীমতি সুজাতা রামালিঙ্গম। রঙ্গ প্রবেশের জন্য তাকে তৈরি করেন কীর্তি রামগোপাল। গুরুর কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্র এখন ছড়িয়ে দিতে চান নতুনদের মাঝে। অর্থী বলেন, নাচ হলো গুরুমুখী বিদ্যা। তাই নৃত্য আর কোরিওগ্রাফিই আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গা। আমি মনে করি নাচ শেখানো আমার গুরুদায়িত্ব।

কথায় কথায় আসে সাধনার কথা। শ্রদ্ধায় নত হয়ে নাম নেন লুবনা মারিয়ামের। অর্থীর উদ্যম ও সম্ভাবনা দেখে সাধনার প্রায় সব প্রযোজনাতেই তাকে রেখেছিলেন এই নৃত্যশিল্পী ও সংগঠক। কল্পতরুতে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের নাচ শেখান অর্থী।

শিক্ষার্থীদের নিয়ে মজার কোনো ঘটনা জানতে চাইলে বলেন, কিছুদিন আগে আমি নাচের স্কুল শেষে ‘পাঠাও’ রাইডের বাইকে বাড়ি ফিরছি। ভাড়া পরিশোধ করতেই পাঠাও চালক বলে উঠলেন, ‘খালামণি আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলি।’ আমি বললাম ছবি তুলবেন ঠিক আছে কিন্তু আমাকে খালামণি ডাকার কারণ কি? তখন তিনি বললেন, আপনি দুরন্ত টিভিতে শিশুদের নাচ শেখানোর একটা প্রোগ্রাম করতেন না? আমি বললাম হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমার মেয়ে আপনার প্রোগ্রাম দেখে নাচ শিখতো আর আপনাকে খালামনি ডাকতো। এখন মেয়ের পাশাপাশি বাসার সবাই আপনাকে খালামণি ডাকি। আমি শুনে যেমন অবাক হয়েছি তেমন খুশিও কম হইনি। থেমে থেমে কথা বলছিলেন অর্থি। ‘শিক্ষার্থীদের গল্প বলতে গিয়ে মনের অজান্তেই হেসে ফেলে বললেন। ‘ছোটদের নাচ শেখাতে গিয়ে অভিযোগ সমাধান করতে হয় বেশি। ওদের যেদিন নাচ করতে ভালোলাগে না, সবগুলো মিলে আমার কোলের মধ্যে গড়াগড়ি খায় আর বায়না ধরে গল্প শোনার।

নাচ শেখানোর সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন। আমার বয়স তখন ১৯। আমার নাচের এবং প্রোগ্রামের ভিডিও দেখে আমেরিকার একটি সংস্থা ওদের একটি প্রোগ্রামে কোরিওগ্রাফার হিসেবে ডাকল। বিমানবন্দরে ওরা আশা করেছিল একটু ভারি বয়সের লম্বা চওড়া শাড়ি পরে কোনো মহিলা আসবেন। এজন্য ওরা আমাকে হিসাবের মধ্যেই ধরেনি। পরে আমি যখন ওদের খুঁজে বের করলাম, ওরা আমাকে দেখে খুব হতাশ হলো। এত ছোট্ট মেয়ে কি শেখাবে আর কিই বা পারবে। মুখ কালো করে গাড়িতে উঠে ওদের ওখানকার একজন শিক্ষককে ডাকল আমাকে সাহায্য করার জন্য। পরের দিন গিয়ে দেখি ৬০ জন প্রবাসী বাঙালিকে নিয়ে ওই প্রোগ্রামটা কোরিওগ্রাফি করতে হবে। এরপর আমি যখন নির্দেশনা দেওয়া শুরু করলাম ওরা তো অবাক। কি ব্যাপার এত ছোট একটা মেয়ে আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছে। মঞ্চের ওপর জুতা পরে উঠতে, খাবার খেতে নিষেধ করছে। কিন্তু আমি যেহেতু কোরিওগ্রাফার তাই আমার মতো করে সবাইকে দিয়ে কাজ করানো শুরু করলাম। এরপর যেদিন প্রোগ্রাম শেষ হলো, সবার সে কি প্রশংসা। আমাকে আমেরিকায় রেখে দেওয়ার জন্য সবাই পাত্র দেখা শুরু করেছিল।

শখের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থী বলেন, আমার শখ হলো ঘুরে-বেড়ানো। ভারতের এমন কোনো প্রদেশ নেই যেখানে আমি যাইনি। পাহাড় আমাকে ডাকে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হারিয়ে যান অর্থী। স্বপ্নালু চোখে বলে চলেন, দুচোখ জুড়ে পৃথিবীটা দেখতে চাই। পাহাড়ের প্রতিটা ভাঁজের গল্প জানতে চাই। ছড়িয়ে পড়তে চাই ঝরনার প্রতিটি জলকণার মতো। শুদ্ধতার স্বাদ পাই প্রকৃতির ছোঁয়ায়। আমার কাছে শখগুলোকে পূর্ণতা দিয়ে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই জীবন।

সর্বশেষ খবর