শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮

অনন্য উচ্চতায় ডা. আবদুল মতিন

রাশেদুর রহমান

অনন্য উচ্চতায় ডা. আবদুল মতিন

‘মি. নেইমার, দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন। ডোপ টেস্টের জন্য আপনার নমুনা সংগ্রহ করা হবে।’ ব্রাজিল-কোস্টারিকা ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমারকে এভাবেই অনুরোধ করছিলেন বাংলাদেশের ডাক্তার মো. আবদুল মতিন। ফিফার ডোপিং কন্ট্রোল টিমের একজন ডিসিসি (ডোপিং কন্ট্রোল চ্যাপেরন)। রাশিয়া বিশ্বকাপে সারা বিশ্বের সেরা ৪৪ জন ডাক্তার নিয়ে গড়া হয়েছিল ডোপিং কন্ট্রোল টিম। সাড়ে সাত হাজার ডাক্তারের মধ্য থেকে ১১ বার ইন্টারভিউ নিয়ে অনেকটা ‘সিন্ধু সেচে মুক্তা আনা’র মতোই ফিফা খুঁজে নিয়েছিল এসব ডাক্তারদের। ফিফার গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগে কাজের যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশকে এক অনন্য গৌরব উপহার দিয়েছেন মো. আবদুল মতিন।

ফুটবল ভালোবাসেন তিনি। ফুটবলারই হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা-মায়ের চোখ রাঙানিতে বেশিদূর এগুতে পারেননি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মো. আবদুল মতিন। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও ৩২ বছরের যুবক ফুটবলেরই সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফায় কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফিফার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর একটি ছিল অ্যান্টি ডোপিং টিম। এই টিমেই গ্রুপ লিডার হিসেবে কাজ করেছেন ডাক্তার মতিন। রাশিয়ার প্রধান সাংস্কৃতিক নগরী সেন্ট পিটার্সবার্গ ভেন্যুতে তিনিই ছিলেন দলনেতা। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ফিফার অ্যান্টি ডোপিং বিভাগে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন মতিন। তবে তিনি বলেন, ‘এই গৌরব আমার নয়। যে মাটিতে আমি জন্মেছি, এই গৌরব তার। বাংলাদেশের।’ হাফেজ আবদুর রহিম এবং জহুরা বেগম দম্পতির পঞ্চম সন্তান মো. আবদুল মতিন। বড় ভাই মোহাম্মদ আবদুস সালাম মোহাম্মদপুর সরকারি স্কুলে ইংরেজি পড়ান। মেজো বোন ডাক্তার। ছোট বোনও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিক্ষকতা করছেন। মেজো বোনের দেখানো পথেই এবার ছুটে চলেছেন আবদুল মতিন। নিজেকে নিয়ে বলতে গিয়ে বার বারই আবদুল মতিন বলছিলেন, ‘আমি আমার পরিবারের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ। আমাকে এগিয়ে দিতে পরিবারের সবাই প্রেরণা দিয়েছেন। তাদের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়েছে।’ তিনি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের প্রতি। এই দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি তার গভীর অনুভূতি প্রতিটি তরুণের জন্যই হতে পারে প্রেরণার এক নতুন উৎস।

যোগ্যতা প্রমাণ করেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ডা. আবদুল মতিন। নরসিংদীর জামিয়া কাসিমিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে রাশিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে ২০০৫ সালে দেশটির রোস্তভ স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছর রাশিয়ান ভাষা শিক্ষা কোর্স সম্পন্নের পর শুরু করেন ৬ বছরের মেডিকেল কোর্স। ২০১২ সালে এই কোর্স শেষ করে সেন্ট পিটার্সবার্গ নর্থ ওয়েস্টার্ন স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখানেই হৃদরোগ বিভাগে পিএইচডি করছেন আবদুল মতিন।

ফিফার অ্যান্টি ডোপিং বিভাগে কাজ করতে রাশিয়া থেকেই পরীক্ষা দিয়েছিলেন মতিন। তার মতো আরও অনেক রাশিয়ানও পরীক্ষা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপে ফিফার অ্যান্টি ডোপিং বিভাগে কাজ করতে। গোটা বিশ্ব থেকে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে ১১ বার সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিফা বেছে নিয়েছে ৪৪ জনকে। তার মধ্যে আছেন বাংলাদেশের ডা. আবদুল মতিন। অনেক রাশিয়ান আবেদন করলেও কারোরই ভাগ্যে জোটেনি ফিফার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজ করার সুযোগ। বাছাই করা ৪৪ জনকে বিশ্বকাপের ১১টি শহরে দায়িত্ব দিয়েছে ফিফা। সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে কাজ করেছেন মতিনসহ চারজন। ফিফার ডোপিং কন্ট্রোল বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন প্রফেসর ক্লিন ফিল্ড জেমস নামের এক জার্মান। যার পদবি ডিসিও (ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার)। তার অধীনে যে চারজন কাজ করছেন তাদের মধ্যে ডিসিসি (ডোপিং কন্ট্রোল চ্যাপেরন) হিসেবে এক নম্বরে আছেন বাংলাদেশের মতিন। বাকি তিনজন ইতালি, তিউনিসিয়া ও নাইজেরিয়ার।

ডোপিং পরীক্ষা দিতে হয় বড় বড় সুপারস্টারদেরও। প্রতি ম্যাচে দুই দলের ২ জন করে খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয় নমুনা পরীক্ষার জন্য। তবে তা অবশ্যই সন্দেহের ভিত্তিতে নয়, লটারির মাধ্যমে। ম্যাচের বিরতিতে দুই দলের ম্যানেজারের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে চারজনকে নির্বাচন করা হয়। ম্যাচের পর ড্রেসিং রুমে প্রবেশের আগেই নির্বাচিত চার খেলোয়াড়কে ডোপিং কন্ট্রোল নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রক্ত ও মূত্র সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সুইজারল্যান্ডে। ফিফার ল্যাবরেটরিতে সেগুলো পরীক্ষা করা হয়। ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত নমুনা সংরক্ষিত থাকে ফিফার ল্যাবরেটরিতে। যদিও ডোপ টেস্টের রেজাল্ট ২ মাসের মধ্যেই দিয়ে দেয় ফিফা। সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৭টি খেলায় মোট ১১ জন ফুটবলারের ডোপ টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করেছেন মতিন। ব্রাজিলের নেইমার ও থিয়াগো সিলভা, মিসরের মোহাম্মদ সালাহ, রাশিয়ার ইগনেশেভিচ ও চেরিসভ, ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইন, ড্যানি ওয়েলব্যাক, জেসে লিনগার্ড, রুবেন লুফটস চেক ও জর্ডান হেন্ডারসন, বেলজিয়ামের কর্টয়েস, নাইজেরিয়ার ওবি মাইকেল ও আহমেদ মুসা, আর্জেন্টিনার ক্রিস্টিয়ান ও অতামেন্দি।

ব্যক্তিজীবনে কোরআনে হাফেজ ডা. আবদুল মতিন। বিয়ে করেছেন একই জেলার জান্নাতুল মাওয়াকে। ঢাকার সমরিতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত তার স্ত্রী। মতিন ও জান্নাতুল মাওয়ার একমাত্র ছেলে আজনাফ সাফওয়ানের বয়স ৬ মাস। বিশ্বকাপে অ্যান্টি ডোপিং ডিপার্টমেন্টে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে ফিফার সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে চান মতিন। না হলে তার লক্ষ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করা। বিশ্বকাপে কাজ করে যে সনদ পাবেন মতিন সেটাকেই বিশাল মনে করছেন তিনি। এর বাইরে তেমন কিছু চাওয়ার নেই তার। ‘আমি একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ফিফার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজের সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার এবং আমার দেশের জন্য গর্বের। আমি কাজের মাধ্যমে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই’- বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন ডা. আবদুল মতিন। তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বকাপের মতো এমন এক মহাযজ্ঞে বাংলাদেশকে উপস্থানের সুযোগ পেয়ে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্বিত ও আনন্দিত। বিশ্বকাপ থেকে কিছু চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে যা জীবন চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করবে। স্বপ্নের মতো ছিল বিশ্বকাপের ৩৫টি দিন। তবে প্রতিটি মুহূর্তেই আমি খুব মিস করেছি লাল-সবুজের পতাকা। খুব ভালো লাগত বিশ্বকাপে যদি বাংলাদেশ থাকত। আমার স্বপ্ন, এক দিন বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে আর আমি ডোপিং কন্ট্রোল বিভাগে দায়িত্ব পালন করব।’

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নরসিংদীতে ছাত্রজীবনে জেলা লিগ ছাড়াও খেলেছেন জেলার অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। বাবা-মায়ের শাসনে খেলা ছেড়ে দিলে ফুটবল ছাড়েননি মতিন। পরে নিজ জেলার লিগে ধারাভাষ্য দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপে ধারাভাষ্য দিয়ে পুরস্কারও জিতেছেন মতিন। মাদ্রাসা জীবনে পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে। একাধিকবার সেরা হয়েছেন উপস্থিত বক্তৃতায়ও। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

আবদুল মতিন মনে করেন, তরুণরাই একটি দেশকে বদলে দিতে পারে। সে জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হতে হবে। নিজেদের গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত মানবিক গুণাবলীসমৃদ্ধ করে। এক দিন এই তরুণরাই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর